জিয়া, জামালগঞ্জ থেকে:: সুনামগঞ্জের বৃহৎ হাওর শনির হাওরে পড়েছে শকুনের চোখ। শকুনের বিষাক্ত থাবায় বুলুন্ঠিত হচ্ছে সাধারণ জনগণের স্বপ্ন।
অতি গুরুত্বপূর্ণ শ্লুইচগেট ভেঙ্গে খাম্বা চুরি করে তাহিরপুর -জামালগঞ্জ দুই উপজেলার লাখ লাখ মানুষের স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করেছে পিআইসির কাজে জড়িত থাকা দুষ্কৃতিকারীরা।
জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর দুই উপজেলার মধ্যস্থলে লালুরগোয়ালা ক্লোজার সংলগ্ন স্থানের এঘটনায় গতকাল ১৪ ফেব্রæয়ারি জামালগঞ্জ উপজেলার দুইজনকে আটক করেছে তাহিরপুর থানার পুলিশ। আটককৃতরা হলো, যুবলীগের নেতা ও জামালগঞ্জ উপজেলার নয়াহালট গ্রামের বাসিন্দা আবুল আজাদের আপন ভাতিজা নেহেরুল ও তার সহযোগি সেলিম মিয়া।
যুবলীগ নেতা আবুল আজাদের ভাই নয়াহালট গ্রামের ইউসুফ আলীর পুত্র ধৃত নেহেরুল মিয়া এবং একই উপজেলার চানপুর গ্রামের মর্তুজ আলীর পুত্র সেলিম মিয়া বলে জানা গেছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার শনির হাওর অংশে ৭,৮,৯নং পিআইসির বাঁধের কাজে নিয়োজিত এসকোভেটর মেশিন দিয়ে ¯øুইসগেট ভাংঙ্গার এই ঘটনা ঘটায়।
এই ঘটনায় তাহিরপুর থানার এসআই আলমাছ মিয়া নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১৪ফেব্রæয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় এই দুইজনকে গ্রেফতার করেছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাহিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আতিকুর রহমান জানিয়েছেন আটককৃতদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
এদিকে শনির হাওরপাড়ে ভেঙ্গে ফেলা ¯øুইচগেটের আশেপাশে থাকা কৃষকেরা জানিয়েছেন, শনির হাওর জামালগঞ্জ উপজেলা অংশের উপ-প্রকল্পের ৭,৮,৯নং এই তিনটি পিআইসিতে বেনামে আড়ালে রয়েছেন যুবলীগ নেতা আবুল আজাদ। তারই আপন ভাতিজা নেহেরুল মিয়া
এসব পিআইসির কাজে এসকোভেটর তদারকিতে থাকার সুবাদে হাওরবাঁধের কাজে অবস্থান করছিল। নেতার ভাতিজা হবার সুযোগ নিয়ে অপর মোটর বাইক চালক সেলিম মিয়াকে সহযোগি করে একটি সুবিশাল হাওরের সরকার নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ ¯øুইটগেট ভেঙ্গে বিভিন্ন উপকরণ চুরির দু:সাহসিক এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
এঘটনায় তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ এলাকার শনিরহাওরে বোরো-ইরি কৃষি জীবিকায়নে নির্ভরশীল লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর মাঝে ফসল হারানোর আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়িত হাওর বাঁধে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে এবছর প্রায় ৮কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদিত ৬৯টি প্রকল্পের অধিকাংশের কাজই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, যদিও সংশ্লিস্টদের তরফ থেকে মুখে মুখে সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এরকম দাবী করা হলেও বাস্তবে কোন কোন পিআইসিতে এখনও ৪০থেকে ৫০ভাগ কাজই সম্পন্ন করতে পারেনি রাজনৈতিক প্রভাবে প্রণীত পিআইসিরা।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এবছর জামালগঞ্জে ৬৯টি প্রকল্পের মধ্যে শনির হাওরের একাংশে রয়েছে ১২টি, পার্শ্ববর্তী মহালিয়া হাওরে ৫টি, পার্শ্ববর্তী হালির হাওরে ২৮টি, পাগনার হাওরে ২০টি, মিনি-পাগনায় ৩টি, জোয়ালভাঙ্গায় ১টি।
এতে বিগত সময়ে ভাল কাজ করেছেন এরকম পিআইসিদের বাদ দিয়ে এবছর একপেশে রাজনৈতিক বলয়ের বৈচিত্রময় পিআইসি সিন্ডিকেট চক্রের হাতে হাওরের একমাত্র বোরোধান রক্ষায় “প্রাণের বাঁধ” নির্মানের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, হাওর বাঁধের দ্বিতীয় ব্যাচে গত বছর জামালগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন হাওরে ৫৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ফসল রক্ষা হলেও এবছর অতিরিক্ত ১৬টি প্রকল্প নতুন সংযোজন করে ৬৯টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর এতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পক্ষের দাপটে অধিকাংশ পিআইসিতে এবার পাত্তা পাননি জমি সংলগ্ন কোন প্রকৃত কৃষক। সবই স্থানীয় নানা রকমের পেশাজীবী নেতাকর্মী।এতে তৃণমূল জনমনে জেগেছে সিন্ডিকেট কর্তৃক বাঁধ নির্মানে মোটা দাগে বরাদ্দ লোপাটের আশংকা আর বাঁধ বিপর্যয়ের অজানা ভীতি। ইতোমধ্যে সিন্ডিকেট প্রণীত পিআইসির শম্বুক গতির মর্জিমাফিক কাজে ও শনির হাওরে ¯øুইচগেট ভেঙ্গে ফেলায় শংকিত হয়ে পড়েছে তৃনমূল কৃষকেরা।
কারণ হিসেবে কৃষকরা জানান, স্থানীয় সংবাদকর্মী সমেত এই সিন্ডিকেট চক্রকে এলাকায় সর্বদায়ই টিআর,কাবিখা,খাদ্য গুদামে ধান সরবরাহ,সহ সব ধরণের সরকারি বরাদ্দকৃত কাজে সম্পৃক্ত ও তৎপর থাকতে দেখা যায়। ঘুরে ফিরে এই সিন্ডিকেট চক্রই সরকারি বরাদ্দের সুযোগ সুবিধা লুফে নিচ্ছে। এখন হাওর রক্ষার সরকারি ¯øুইটগেটও তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এখন হাওর বাঁধের দখলদারিত্বে অরাজকতায় এই লোপাট মহল বেপরোয়া হয়য়ে পড়ায় সমগ্র হাওর অঞ্চলে চরম অসন্তোষ জন্ম নিয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার বৌলাই নদীর দুইপাড় ঘেষা শনির হাওরের একাংশ সহ হালির হাওরের কয়েকটি বাঁধ প্রকল্পে গিয়ে হতাশাজনক চিত্র দেখা গেছে।সবকটি পিআইসিতে আগাগোড়া অনিয়ম করে দায়সারা ভাবে বাঁধে মাটি ফেলা হচ্ছে। কয়েকটি বাঁধে মাটির কাজে অগ্রগতি হলেও দুরমুজ দেওয়া হচ্ছেনা কোনটাতেই। অনেকটাই গা ছাড়া ভাবে ভাড়াটে লোক বসিয়ে প্রকল্পের কাজ ঢিমেতালে চালানো হচ্ছে। অনেক বাঁধে পিআইসির কোন সদস্যকে পাওয়া যায়নি।
শনির হাওর উপ-প্রকল্পের লালুর গোয়ালা নামক স্থানে ৭নং,৮নং,৯নং পিআইসিতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে সবেমাত্র এসকোভেটর মেশিন নামানো হয়েছে বাঁধে মাটি ফেলার জন্য। ৯নং পিআইসির সভাপতি দ্বীন ইসলামকে লাগোয়া ৭নং ও ৮নং প্রকল্প স্থলে এসময় পাওয়া যায়।
তিনি জানান, ৭নং,৮নং,৯নং, এই তিনটি প্রকল্পই রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নয়াহালট গ্রামের এক নেতা জনৈক আবুল আজাদের বেনামে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭নং, ৮নং, ৯নং বাঁধে প্রায় সাড়ে ৪৪ লাখ টাকার ঐ তিন প্রকল্পের নিয়ন্ত্রক ঐ নেতার হাতে সম্প্রতি হাওর বাঁধসহ আরো সকল বাঁধ প্রকল্পের অনিয়মের প্রতিবাদে জেলা শহরে সংবাদ সম্মেলন করায় জামালগঞ্জের জনৈক বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধাকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতার মদদপুষ্ট হওয়ার সুবাদে লোপাট সিন্ডিকেটের হোতা রাজাকার বংশের উত্তরসূরি এই নবীন নেতা এতই বেপরোয়া ও বেসামাল হয়ে উঠেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। শনির হাওর উপ-প্রকল্পের লালুর গোয়ালা অংশের ৭নং ও ৮নং প্রকল্প বিষয়ে বেহেলী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রণব কান্তি রায় জানান, এটি হচ্ছে শনির হাওরে এই অংশের অন্যতম ক্লাজার ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ। এখানে স্থানীয় বৌলাই নদীর খাড়া পাড় ঘেষা মাত্র ১২০ মিটার ক্লোজারে প্রায় ৩৪লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্পের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তবে কাদাভেজা মাটি ভরাটের কাজ হচ্ছে ধীর গতিতে দায়সারা ভাবে এবং খুব নিম্ন মানের। এই ক্লোজার ক্ষতিগ্রস্ত হলে শনির হাওর পাড়ের লাখ লাখ হত দরিদ্র মানুষের কপাল পুড়বে। এই হাওরে জমি চাষ করেছেন
এরকম একাধিক কৃষক জানান, এবছর রাজনৈতিক বিষফোঁড়া হিসেবে বিবেচিত নেতারা ছলে-বলে-কৌশলে আড়ালে থেকে বেনামে অনেক পিআইসি নিয়েছেন। তাই বৈশাখী প্রবল প্রাকৃতিক দূর্যোগে যদি বাঁধের কোন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয় ঘটে তবে এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশে পাওয়া যাবেনা। কারণ এসব বাঁধ প্রকল্পের মূখ্য নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট আড়ালের হোতারা। মূলত তালিকায় থাকা সভাপতি-সেক্রেটারি কেউই বাঁধের কাজে নেই। প্রকল্প খাতে বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের চেকে স্বাকর করে নিয়ে কথিত পিআইসির সভাপতি-সেক্রেটারিদের রোজের কামলা হিসেবে নামমাত্র সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় করা হয়। তাই চলমান বাঁধের কাজে প্রকল্পের স্থানে কোন পিআইসি সদস্যকে পাওয়া যায়না। কৃষকেরা বলেছেন এসব পিআইসির নিয়ন্ত্রক কেউই আশেপাশে নয়। সবাই দূটবর্তী অন্য এলাকার লোকাল নেতা ও ফরিয়া দালাল। আর এটাই হাওর লাগোয়া প্রান্তিক কৃষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। ¯øুুইচগেট ভেঙ্গে এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন যেহেতু এটা দুটি উপজেলা অংশ নিয়ে অবস্থিত এবং আটককৃতদের তাহিরপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেহেতু জামালগঞ্জ এলাকা থেকে যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার তা করবেন। বিষয়টি তিনি জেলা প্রশাসককে অবগত করেছেন বলে জানিয়েছেন।
এব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।