কী সুন্দর ফুটফুটে চেহারা। হাসিমাখা মুখ। দেখলে মনেই হয় না কোনো রোগবালাই আছে তার। আয়াত হক। বয়স ৭মাস।
নড়াচড়া নেই। মা-বাবা তাকে যে পাশে ফেরাবেন, সেই পাশেই আয়াত পড়ে রয়। ঘাড় ফেরানোর শক্তি নেই। হাত-পাসহ পুরো শরীর তুলতুলে। বলা যায় নিস্তেজ শরীরটাই শুধু আয়াতের৷
‘স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ) নামক বিরল রোগে আক্রান্ত সে। রোগটির সাথে সিলেট তথা দেশের মানুষ একেবারে অপরিচিত বললেই চলে।
দুই বছরের মধ্যে চিকিৎসা না করালে মৃত্যু নিশ্চিত বলে নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসকদের ভাষ্য। তখন তো মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা। প্রতিনিয়ত নিজের সন্তানকে নিঃশেষ হতে দেখে কোনো কুল-কিনারাহীণ আয়াতের মা-বাবা।
চিকিৎকদের মতে, পেশির সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে যে মোটর নিউরোন, তা নষ্ট হওয়াই জিনঘটিত এই বিরল রোগের কারণ। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী- টাইপ ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত হয় ‘এসএমএ’ রোগ। বাংলাদেশে এর কোনো চিকিৎসা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে একটি কোম্পানি কয়েক মাস আগে এর ওষুধ বাজারে নিয়ে আসলেও তা কেনা সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত। বর্তমানে ‘এসএমএ’ প্রতিরোধক ইনজেকশনের দাম ২২ কোটি।
এছাড়াও এ রোগ নিরাময়ে ‘রিসডিপ্লাম’ নামের মুখে খাওয়ার ওষুধ রয়েছে। এটি এক ধরনের জিন থেরাপি। তবে প্রতি মাসে খাওয়াতে হয় ১০ লাখ টাকার ওষধু। আর খাওয়াতে হয় মৃত্যু পর্যন্ত। ফলে ওষুধ বা চিকিৎসা না পেয়ে আক্রান্ত শিশুদের স্বজনরা হয়ে পড়েন দিশেহারা।
সিলেট শহরতলীর মেজরটিলা ইসলামপুরের বাসিন্দা জুনেদ হক ও ফারজানা আক্তার দম্পতির ২য় কন্যা আয়াত হক।
আয়াতের জন্ম বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২০জুন।
জুনেদ ও ফারজানা সিলেটের বার্তাকে বলেন- জন্মের ২-৩ মাস পর আয়াতের হাত-পা ও ঘাড় স্বাভাবিক নড়চড়া না করলে তাদের মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করল। তারা সিলেটে একাধিক শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান তারা। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ‘মেডেস্ক’ নামক বেসরকারি হাসপাতালের ডা. মিজানুর রহমানের কাছে আয়াতকে নিয়ে যান।
আয়াতকে প্রাথমিকভাবে চেকআপ করে ডা. মিজান জানান- শিশুটি ‘স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাটরোফি’ বা ‘এসএমএ’ রোগে আক্রান্ত।
এসময় তিনি কয়েকটি পরীক্ষা করাতে বলেন। এর মধ্যে একটি ‘এসএমএ’ রোগ শনাক্তের পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য আয়াতের শরীরের রক্ত প্রসেস করে ভারতে পাঠানো হয়। কারণ- এ পরীক্ষা দেশে হয় না। এক মাস পর পরীক্ষার রিপোর্ট আসে ঢাকায়। রিপোর্ট দেখে জুনেদ ও ফারজানাকে নিশ্চিত করে বলা হয়- আয়াত ‘এসএমএ’ রোগেই আক্রান্ত। জানানো হয়- বাংলাদেশে এর কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ নেই।
পরে ‘এসএমএ’ রোগ বিশেষজ্ঞ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজির চিকিৎসক ডা. জোবায়দা পারভিনের কাছে তারা আয়াতকে নিয়ে যান। পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের এই কনসালটেন্ট জুনেদ ও ফারজানাকে পরামর্শ দেন- বিদেশি ওষুধ কোম্পানি ‘নোভার্টিস’ বরাবরে একটি আবেদন করার জন্য। কোম্পানিটি প্রতি বছর লটারির মাধ্যমে বিশ্বের ‘এসএমএ’ আক্রান্ত দুই শিশুকে ২২ কোটি টাকা দামের ‘জোলগেনসমা’ নামের ইনজেকশনটি বিনামূল্যে দিয়ে থাকে।
আয়াতের মা ব্যাংক কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন- ডা. জোবায়দা পারভিনের এ পরামর্শের পর আমরা ‘নোভার্টিস’ বরাবরে আবেদন করেছি ঠিকই। কিন্তু সারা বিশ্বের আবেদনকারীদের মধ্য থেকে তারা লটারির মাধ্যমে দুই শিশু নির্বাচিত করে। এখন লটারিতে আমার আয়াতের নাম উঠবে কি না সেটা তো বলা যায় না।
যদি না উঠে তবে কি চোখের সামনেই আমাদের সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে? মা-বাবা হয়ে সে দৃশ্য আমরা সহ্য করবো কীভাবে? আমার আয়াত যখন শ্বাসকষ্টে ভোগে তখন কষ্টে আমাদের বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। অনেক সময় ৩-৪ মিনিট পর্যন্ত সে স্বভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। আমরা তখন আজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সিলেটের বিত্তবান এবং সবিশেষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফারজানা বলেন- আমাদের প্রধানমন্ত্রী কোটি কোটি টাকা খরচ করে করোনার টিকা বিদেশ থেকে নিয়ে এসে দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ ফ্রি দিয়ে যে সুনাম কুড়িয়েছেন তা আর পৃথিবীর আর কোনো সরকার পারেনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস- একমাত্র আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি চান তবে বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করে আমার আয়াতের মতো বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুগুলোকে বাঁচাতে পারেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের শুধু বিষয়টি সরকারের সুনজরে নিয়ে আসতে হবে।
আয়াতের বাবা জুনেদ হক সিলেটের বার্তাকে বলেন, বলছেন যদি আমার দুইটা কিডনী বিক্রি করে মেয়েটির চিকিৎসা করবনো যেতো, তবে আমি তাই করতাম। সহায়-সম্পত্তি যা আছে সবকিছু বিক্রি করলেও যদি মেয়েটি সুস্থ হত। তবে আমি তা করতে প্রস্তুত। কিন্তু এই ২২ কোটি টাকা কীভাবে ম্যানেজ করবো। কে দেবে এত টাকা। কোথায় কার কাছে বলবো।
এ রোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাটরোফি’ বা ‘এসএমএ’ একটি বিরল রোগ। এ রোগে শিশুদের স্পাইনাল কর্ডের স্নায়ুকোষ ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যায় বা মারা যেতে থাকে। যেসব স্নায়ুকোষ মাংসপেশী নিয়ন্ত্রণ করে, সেই স্নায়ুকোষগুলো ধ্বংস হওয়ার কারণে মাংসপেশী ক্ষয়িঞ্চু হতে থাকে। এর চারটা টাইপ আছে বলেও জানান এই চিকিৎসক। এর মধ্যে টাইপ ওয়ান সবচেয়ে মারাত্মক। এ অবস্থায় রোগী বসতে পারে না, হাত-পা নাড়াতে পারে না। এদের শরীর হয়ে পড়ে তুলার মতো নরম। যদিও এসব রোগীর চোখে-মুখে অত্যন্ত ব্রাইটনেস লক্ষ্য করা যায়। জন্মের এক থেকে দুই মাসের মধ্যে শিশুর শরীরে এর লক্ষণ ফুটে ওঠে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন হাড়ে- বিশেষ করে মেরুদণ্ডে ব্যথা হওয়া, খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।
তিনি বলেন, রোগটির টাইপ-১ সাধারণত ৬ মাসের শিশুদের ক্ষেত্রে ধরা পড়ে। সঙ্গে শুরু হয় বেশ কিছু জটিল উপসর্গ। টাইপ-২ সাত থেকে ১৮ মাসের শিশুদের ক্ষেত্রে ধরা পড়ে। এটি আগের ধাপের চেয়েও জটিল। টাইপ-৩ আটার বছরে উপরে শিশুদের ক্ষেত্রে ধরাপ পড়ে। তবে এক্ষেত্রে উপসর্গ তেমন জটিল হয় না। আর টাইপ-৪ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। এর উপসর্গ মৃদু হয়।
তিনি আরও কে বলেন, বাংলাদশে এ রোগের শনাক্তকরণ ব্যবস্থা নেই। এর পরীক্ষা ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়। প্রথম যখন এর ইনজেকশন আন্তর্জাতিক একটি কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে তখন বাংলাদেশি টাকায় এর দাম ছিলো ৩৭টি কোটি টাকা। এখন কমেছে, তবে ২২ কোটি টাকা। হয়তো আগামীতে আরও কমবে। তবে এই মুহুর্তেও এ রোগে কোনো শিশু আক্রান্ত হলে দেশের ৯৯ ভাগ মানুষই সম্ভবত টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও সংস্থা একসঙ্গে কাজ করলে হয়তো একটি ফান্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সে ফান্ড থেকে আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা যাবে।