*অপেক্ষমান দেড় হাজার আসন
*৮ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত পুরো টার্মিনাল
*আসাম টাইপ বাড়ি, চাঁদনীঘাটের ঘড়ির আদলে নকশা
আধ্যত্মিক রাজধানী সিলেটেই দেশসেরা প্রথম নান্দনিক আর শৈল্পিক কারুকাজের সুবিশাল বাস টার্মিনালের কাজ শেষ হয়ে উদ্বোধনের দিনক্ষণ গুনছেন সিলেটবাসী।
কারুকার্যময় লাল ইটের দেয়াল। ইট রঙের স্টিলের ছাউনি। গাছপালা আবৃত গ্রিনজোন। বিমানবন্দরের আদলে আলাদা প্রবেশ ও বহির্গমন পথ। যাত্রীদের জন্য প্রায় দেড় হাজার আসনের বিশাল ওয়েটিং লাউঞ্জ। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে নির্মাণের শেষ দিকে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, ফিনিশিংয়ের কিছু কাজ বাকি। উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সিলেটবাসী চান প্রধানমন্ত্রী হাত দিয়ে উদ্বোধন হোক। অথবা তিনি অনুমতি দিলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও উদ্বোধন করতে পারেন। তবে নভেম্বরের আগে উদ্বোধন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
২০১৮ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে (এমজিএসপি) প্রকল্পের আওতায় সিসিকের উদ্যোগে ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটির কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ২০২২ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু করোনা ও বন্যার কারণে কাজ শেষ হতে দেরি হয় এসব কথা বলেন, সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।
প্রকৌশলী নূর আরও বলেন, জুনেই বাস টার্মিনালের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সিলেটের এই বাস টার্মিনাল হবে দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক বাস টার্মিনাল। নানন্দিক স্থাপত্য শৈলীও সবার নজর কাড়বে। এছাড়া সুযোগ সুবিধাও থাকবে অনন্য।
সিলেট সিটি করপোরশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, চালু হওয়ার পর এ টার্মিনালই হবে দেশের সবচেয়ে আধুনিক সুবিধা সংবলিত বাস টার্মিনাল। এখানে যাত্রীদের বিশ্রাম নেয়ার পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া প্রত্যেক রুট অনুযায়ী থাকবে আলাদা বাস পার্কিং জোন, এন্ট্রি ও এক্সিটের ব্যবস্থা।
টার্মিনালে যাত্রীরা আধুনিক ও উন্নতমানের সব সেবা পাবেন উলে¬খ করে মেয়র বলেন, টার্মিনালটি চালু হওয়ার পর এ এলাকার চেহারা পাল্টে যাবে।
সরেজমিনে টার্মিনাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। কারুকার্যময় লাল ইটের দেয়াল, ইট রঙের স্টিলের ছাউনি, গাছপালা আবৃত গ্রিনজোন। বিমানবন্দরের আদলে আলাদা প্রবেশ ও বহির্গমন পথ। যাত্রীদের জন্য প্রায় দেড় হাজার আসনের বিশাল ওয়েটিং লাউঞ্জ। নতুন এই টার্মিনালের নকশা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের তিন শিক্ষক সুব্রত দাশ, রবিন দে ও মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
৬ তলা ভিত্তির উপর ৩ তলা কমপে¬ক্সটি বাস্তবায়ন করছে ডালি কনস্ট্রাকশন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আসাম টাইপ বাড়ি আর আলী আমজদের ঘড়ির স্থাপনার সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয় ঘটিয়ে নির্মিত হয়েছে এই বাস টার্মিনাল। নগরের কদমতলী এলাকায় পুরনো বাস টার্মিনালের স্থানেই ৮ একর জায়গা জুড়ে এই টার্মিনাল।
নকশা প্রসঙ্গে সুব্রত দে বলেন, বাস টার্মিনালের নকশায় সিলেটের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। সিলেটের ঐতিহ্য আসাম টাইপ বাড়ি, চাঁদনীঘাটের ঘড়ির আদলে নকশা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। আগে এই টার্মিনাল এলাকাটি ছিল ময়লার ভাগাড়।
সংশি¬ষ্টরা জানান, পুরো টার্মিনালের প্রথম অংশের বর্হিগমন ভবনের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩০০ ফুট। এই অংশে ৪৮টি বাস একসঙ্গে থাকতে পারবে। এ ছাড়া যাত্রীদের বসার জন্য রয়েছে ৯৭০ আসনের বিশাল হল। রয়েছে ৩০ আসনের ভিআইপি কক্ষ। ৩০টি টিকিট কাউন্টার ও নামাজের জন্য আলাদা কক্ষ। পুরুষ নারী ও বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন লোকদের ব্যবহার উপযোগী ৬টি টয়লেটও থাকবে এখানে। প্রয়োজনে হুইল চেয়ার নিয়েও টয়লেট ব্যবহার করা যাবে। উপরে উঠার জন্য রয়েছে-লিফট। খাবারের জন্য রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া যাত্রীর জন্য আলাদা শয্যা ও ব্রেস্ট ফিডিং জোন।
টার্মিনালের দ্বিতীয় অংশে আগমন ও বহির্গমন অংশ আলাদা হলেও করিডোরের মাধ্যমে পুরো স্থাপনাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এই বিল্ডিংয়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে সড়কের সঙ্গে গোলাকার ৫ তলা টাওয়ার বিল্ডিংয়ে রয়েছে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অফিস। যেখানে থাকবে পুরো টার্মিনালের সিকিউরিটি কন্ট্রোল ও সিসিটিভি মনিটরিং কক্ষ, পুলিশ কক্ষ এবং পর্যটন অফিস।
টার্মিনালের পেছনে তৃতীয় অংশে নির্মিত হয়েছে একটি মাল্টিপারপাস ওয়েলফেয়ার সেন্টার। যেখানে মালিক ও চালক সমিতির জন্য থাকবে ২৪ বেডের বিশ্রাম কক্ষ, গোসলের ব্যবস্থা, অফিস, লকার ব্যবস্থা, ক্যান্টিন, মিটিং ও অনুষ্ঠানের জন্য মাল্টিপারপাস মিলনায়তন।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডালি কনস্ট্রাকশনের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, এই প্রকল্পের স্টিলের টিন থাইওয়ান থেকে আনা হয়। স্টিল স্ট্রাকচারের জন্য লোহার বার আনা চায়না থেকে। এছাড়া প্রতিটি জিনিস বুয়েটে টেস্ট করা হয়েছে। এখানে বিমানবন্দরের মতো বিশাল ওয়েটিং স্পেস রাখা হয়েছে। আছে পার্কিং জোন ও গাছপালা আচ্ছাদিত গ্রিনজোন। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মাল্টিপারপাস বিল্ডিংয়ে থাকবে বিশাল হলরুম, অফিস, ওয়াশরুম, রেস্ট রুমসহ বিভিন্ন সুবিধা। হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, সব মিলিয়ে এটি হবে দেশের অন্যতম সুন্দর একটি স্থাপনা।