আরব আমিরাত। ৭ টি ছোট ছোট রাজ্য নিয়ে আমিরদের দ্বারা শাসিত এক সমৃদ্ধ দেশ। সে দেশে ভ্রমণের সুযোগ আমার হয়েছিল বন্ধু সাহাবের আমন্ত্রণে। সাহাব সে দেশে প্রতিষ্ঠিত, বসবাস করে আসছেন প্রায় ৩ যুগ ধরে। এবার আমি হাতে কিছু সময় নিয়ে দুবাই বেড়াতে বের হয়েছি। এর আগে অবশ্য লন্ডন, নিউইয়র্ক আসা যাওয়ার পথে দুবাই বিমান বন্দরে যাত্রা বিরতি করেছি কিন্তু ভিসার জটিলতার কারণে শহরের ভিতরে যেতে পারিনি, দেখা হয়নি সৌন্দর্যমন্ডিত, গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলো। বন্ধু সাহাব এবার আমার ভিসার ব্যবস্থা করলেন-তাই তেলসমৃদ্ধ এ অঞ্চল সুন্দর, ঝকঝকে-তকতকে নগরী দুবাই দেখার সুযোগ হলো। দুবাই ক’দিন বেড়ানোর পর মনে হলো আবুধাবি ঘুরে দেখে না আসলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
মোহময়ী দুবাই ভ্রমণ ছিল আমার জন্য এক অপূর্ব, বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আবুধাবিও আমাদের নিরাশ করেনি। বরং বলব, রাজধানী শহরটি আমাদের সামনে যেন রহস্যের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছিল। হ্যাঁ, এ এমনই এক শহর যেখানে স্বপ্ন যেন বাস্তবের মাটি স্পর্শ করেছে। সংযুক্ত সাত আমিরশাহির মধ্যে আবুধাবিই সবচেয়ে বড়। জনসংখ্যাও অন্যান্য আমির শাহির তুলনায় বেশি। আবুধাবি ছবির মতো এক ধোপদুরস্ত শহর। ‘ধাবি’ বলতে আগে বোঝাত মৃগ-মাতারা। এখন বোঝায় মৃগ পিতা। আবুধাবির শাসক হলেন মহামান্য শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বর্তমান সভাপতিও এবং সেনাপ্রধান। তাঁর ভাই শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান হলেন সংযুক্ত আমিরশাহির ফৌজিবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার, তিনি কমান্ডার।
আবুধাবি শহরটির এক চমৎকার জায়গায় এক হাজার দুশো ফুট উঁচু বিশালকার পাথরের উপর শেখ জায়েদ খলিফার রাজপ্রসাদ। সাত বেগম, ১৯ জন পুত্র ও আট কন্যা নিয়ে তাঁর ভরা সংসার। অগাধ সম্পত্তির মালিক। এর মধ্যে জায়েদ স্পোর্টস সিটি এবং শেখ জায়েদ সমুদ্র বন্দর রয়েছে। শেখ পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রয়েছে আল-বাতিন সমুদ্র সৈকত। শেখ পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ গাড়ি চালিয়ে সেখানে আসেন, থাকেন, যান। শেখ জায়েদ খলিফার প্রাচুর্যে ভরা রাজকীয় জীবনযাপনে একটু উঁকি মারার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল।
লুলু একটি কৃত্রিম দ্বীপ। এ দ্বীপের মত প্রায় দুশো দ্বীপ রয়েছে আবুধাবিতে। লুলু নামক কৃত্রিম দ্বীপটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৮০ সালে। তবে আমি প্রথমেই গেলাম আবুধাবির বিশালকার মসজিদটি দেখতে। শুধু আরব দুনিয়ায়ই নয়, সারা বিশ্বে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। মসজিদে পা রাখার পর এর বিশাল আয়তন, জমকালো, অপূর্ব গঠন শৈলী দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এই মসজিদ আকারে কতটা বড়, একটি তথ্য উল্লেখ করলে পাঠকের আন্দাজ করতে আর অসুবিধে হবে না। ৪১ হাজার মুসল্লী সে মসজিদে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
এক হাজার সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার জায়গা রয়েছে মসজিদটিতে। শুধু আয়তন ও নকশায় নয়, বৈভবও চোখে পড়ার মতো। ৩২৪ ক্যারেট সোনার পাতে তৈরি ঝাড়বাতি ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হাতে বোনা গালিচা রয়েছে মসজিদটিতে। মসজিদের প্রসঙ্গ উঠলই যখন, এখানে একটি কথা বলে নিতে চাই। যদিও সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ আরবের ইসলামিক পরম্পরা মেনে চলেন, কিন্তু বিদেশিদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে কোনও অসুবিধে নেই। একটা খোলামেলা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল আবুধাবিতে আমার নজরে পড়ল। বোরখা পরিহিতা আরব মহিলাদেরও দেখলাম রাস্তা দিয়ে স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে হেঁটে বা গাড়ি চালিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। খুব কড়াকড়ি কিছু আমার নজরে পড়েনি।
মসজিদ দর্শনের পর আমি গেলাম হেরিটেজ মিউজিয়ামে। সেখানে এক স্থানীয় রেস্তোঁরায় পরম্পরাগত খাদ্যের স্বাদ আস্বাদান করা গেল। মিউজিয়ামটিতে দেশটির অতীত দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে তার কারুকার্য ও দর্শনীয় বস্তুতে। মরু অঞ্চলের মানুষ একদা কীভাবে জীপন যাপন করত, দৈনন্দিন জীবনে কী কী জিনিষপত্রের প্রয়োজন হত তার একটি ছবি আপনার চোখে ফুটে উঠবে মিউজিয়াম দর্শনে। কফি পট, ছাগলের লোমে তৈরি তাঁবু, ক্যাম্পফায়ারের দৃশ্য সবই দর্শকের জন্য সযতেœ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পুরুষানুক্রমে অর্জিত হস্তশিল্পীদের দক্ষতাও দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।
মিউজিয়াম দেখার পর আমার বন্ধসহ গিয়ে হাজির হলাম আবুধাবির সবচেয়ে বড়, বিখ্যাত হোটেল এমিরেটস প্যালেসে। চমৎকার, জমকালো হোটেলটি আরব ইতিহাসে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে দম্ভ করতে পারে। পশ্চাদপটে নীলা আকাশ এবং সবুজের সমারোহে ভরপুর বাগিচা আর তারই মধ্যে ফোয়ারার রুপোলি পানির ধারা, দিবালোকে দাঁড়িয়ে থাকে হোটেলটি এক সৌম্য সৌন্দর্য নিয়ে। রাতে আলোয় তার জেল্লাই আলাদা। অপরূপ সৌন্দর্য যেন চোখ বাঁধিয়ে দেয়। জানা গেল, হোটেলটিতে একেবারে সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সত্যি বলতে কী, প্রযুক্তিগত কলাকৌশল ব্যবহারের ক্ষেত্রে আবুধাবি অনেকদূর এগিয়ে রয়েছে। এর এক নজির হল মাসদার শহরটি।
এটা এখন এক, একমাত্র শহর হতে চলেছে যা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সৌরশক্তি ও নবীকরণযোগ্য অন্যান্য উপাদানের উপর নির্ভর করবে। সে যাই হোক, হোটেল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আবুধাবির পুরনো হোটেলগুলোর অন্যতম হল হিলটন টাওয়ার। ৩৫ বছরের পুরনো হোটেল। হোটেলে রয়েছে সোনা ও হিরে ব্যবহৃত লামবরজিনি গাড়ি। তখনকার সময়ে খুবই মহার্ঘ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আবুধাবিতে দেখার মতো আরেকটি জায়গা হল নেশন টাওয়ার। যেন দিগন্ত স্পর্শ করেছে। দুটি টাওয়ার আবার আকাশ সেতু দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এত উঁচু সেতু দুনিয়ায় আর কোথাও নেই। আবুধাবি গেলে আল বাতিন সমুদ্র সৈকতে যেতে ভুলবেন না। খুবই আনন্দ পাবেন। আর বিচ-ক্লাবেও একবার ঢুঁ মারবেন। আমরা সাদিয়াত দ্বীপে বিখ্যাত বিচ ক্লাবগুলোর অন্যতম একটি, মন্টে কার্লো ক্লাবে গিয়েছিলাম। চমকপ্রদ ওই ক্লাবে আউটডোর সুইমিং পুল, ওয়ার্কআউট রুম, স্পার সুযোগ রয়েছে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ফেরারি ওয়ার্ল্ড। এ এমন জায়গা সেখানে বাচ্চাই বলুন আর বয়স্কই বলুন, সবার জন্য আনন্দ ও মনোরঞ্জনের ছড়াছড়ি। সারা দুনিয়ার ফেরারি থিম ভিত্তিক মনোরঞ্জন পার্কগুলোর মধ্যে এটা সেরাদের তালিকাভুক্ত।
ফেরারি ওয়াল্ডে রয়েছে বিশ্বের দ্রুতগামী রোলার কোষ্টার এর গতি ৪০ কিলোমিটারসহ প্রায় সব ধরনের উল্লাস ও শিক্ষামূলক রাইডের ব্যবস্থা। আমি ফেরারি ওয়াল্ডে চুটিয়ে মজা করেছিলাম। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল মনোরঞ্জন পার্ক। একথা যেমন সত্য, তেমনি সব দেখেশুনে এক ধরনের বিষাদও চেয়ে গিয়েছিল মনে। কারণ বাবা হিসেবে ছেলেদের কথা খুব করে মনে হয়েছে এই ভেবে যে, ওরা যদি থাকত তাহলে কী আনন্দটাই না পেত। সঙ্গের বন্ধুদের বললাম, আবার যদি কোনদিন এখানে আসি ছেলেদের অবশ্যই সঙ্গে নিয়ে আসব। অবশ্য আমার তিন ছেলেরই কমবেশী দুবাইসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। একজনতো অষ্ট্রেলিয়া আর অন্য একজন এখন পরিবারসহ আমেরিকায় বসবাস করছে।
আবুধাবি ভ্রমণের দিন আমাদের ফুরিয়ে আসছিল, তাই ভাবলাম মল-সবজির বাজারেও একবার ঘুরে আসা যাক। বাজারই বা না দেখা থাকে কেন? গেলাম বাজারে। বাজার খেজুরে খেজুরে ছয়লাপ। আমি অবশ্য বিস্মিত হইনি কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে, তারপরও বলা যায় দুবাই আবুধাবি বর্তমান বিশ্বের সত্যই আকর্ষণীয় ও দর্শণীয় দুটি শহর। আমাদের অবশেষে ভ্রমণের দিন ফুরালো মোহময়ী আরব আমিরশাহির স্মৃতিচারণ করতে করতে।
সাংবাদিক-কলামিস্ট