
বিশ্বের মানচিত্রে থাকা লাল-সবুজের দেশ বাংলাদেশ। এদেশ ওলি-আউলিয়া, পীর-কুতুব, দেশপ্রমিকের একখণ্ড ভূমি। ২০২০-সাল নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। স্মরণে থাকবে এই বছরটিকে।
বিশেষ করে মহামারী করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবের কারণেই এই বছরকে অনেকে ‘বিষে ভরা বিশ’ বলছেন।
অপরদিকে এই বছরটিতে দেশবাসী হারিয়েছেন প্রখ্যাত আলেম-উলামাদের।
দ্বীনের অতন্দ্রপ্রহরী এসব আলেম যুগ যুগ ধরে শান্তি, কল্যাণ ও সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে গেছেন মানুষের মাঝে।
অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২০ সালে তুলনামূলক বেশি আলেমদের হারিয়েছে বাংলাদেশ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছাড়াও শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেম বিদায় নিয়েছেন এ বছর।
বলা হয়ে থাকে, ‘আলেমের মৃত্যু মানে জগতের মৃত্যু’। সে হিসেবে শীর্ষ আলেমদের এ বিদায়ের মিছিল বাংলাদেশের জন্য বিরাট শূন্যতা তৈরি করেছে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী
চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ১০৩ বছর। শাহ আহমদ শফীর জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা গ্রামে।
১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় মহাপরিচালক পদে যোগ দেন তিনি। এরপর থেকে টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি ওই পদে ছিলেন।
শেষ দিন পর্যন্ত হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদিসের দায়িত্বের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক ও আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতুল কওমীয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আল্লামা শফী।
ওলীকুল সম্রাট ছিলেন ও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা শফী ছিলেন সমকালিন মুসলিম দুনিয়ার অবিসংবাদিত নেতা। সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিচারে তিনি ছিলেন অনন্য উচ্চতায় সমাসীন।
শায়খুল হাদিস আবদুল মোমিন শায়খে ইমামবাড়ি
বাংলাদেশের প্রাচীন ইসলামি রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি, শায়খুল হাদিস আল্লামা আব্দুল মুমিন শায়খে ইমামবাড়ি ৭ এপ্রিল, মঙ্গলবার হবিগঞ্জের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ২ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত-গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শায়খুল ইসলাম হজরত মাওলানা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি রাহ.-এর খলিফা ছিলেন তিনি।
শায়খুল হাদিস তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া উমেদনগর মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী ৫ জানুয়ারি, রবিবার ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৮২ বছর। তিনি সিলেটের জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় প্রায় ৫৫ বছর যাবত হাদীসের দরস দিয়েছেন। বৃহত্তর সিলেটের এক ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী পরিবারে তার জন্ম। তাঁর পিতা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (একাংশের) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এবং জেলা সভাপতি হিসেবে দায়ত্ব পালন করেছেন।
তাঁর নানা আল্লামা আসাদুল্লাহ রহ. বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির একজন মুজাহিদ ছিলেন। হবিগঞ্জ এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও সমাজ সংস্কারকও ছিলেন তিনি। তাঁর মামা মাওলানা মুখলেছুর রহমান ছিলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.এর খলীফা।
উল্লেখ্য. দেশের বিশিষ্ট এ হাদিস বিশারদ ও রাজনীতিবিদ দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। কিছুদিন আগেও তিনি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকাৎসাধীন ছিলেন। পরে হার্টের জন্য আইসিজি লাগান তিনি। এর আগে, স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণে কয়েকদিন সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী।
মাওলানা আব্দুস শহীদ গলমুকাপনী
২৪ জুন বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সিলেট নগরীর রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি চার ছেলে, ছয় মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত ও মুরিদান রেখে গেছেন। আল্লামা গলমুকাপনী গত কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন। তিনি ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগেও ভুগছিলেন।
আল্লামা আব্দুস শহীদ গলমুকাপনী ঐতিহ্যবাহী জামেয়া দারুস সুন্নাহ গলমুকাপনের মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। এছাড়াও তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। জমিয়তের প্রতীক খেজুর গাছ নিয়ে ১৯৯৬ সালে সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচনও করেছিলেন তিনি।
আল্লামা আব্দুস শহীদ গলমুকাপনী ১৯৪১ সালে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার গলমুকাপন গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
শায়খুল হাদিস আবদুল হাই
সিলেটের বরেণ্য আলেম ও বাংলাদেশের প্রবীণ আলেমদের অন্যতম শাইখুল হাদিস আল্লামা আবদুল হাই ২৮ মার্চ ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির পাশে মারকাজু তালিমিন্নিসা বংশিবপাশা, আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ নামে একটি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
একইসঙ্গে তিনি সিলেটের একাধিক মাদরাসার শাইখুল হাদিস ছিলেন। বর্ষীয়ান এই আলেম নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৮ বছর। তিনি পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন গুণগ্রাহী ও ছাত্র রেখে যান।
তাবলিগের প্রবীণ মুরব্বি মাওলানা মোজাম্মেল হক
৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি ও কাকরাইল মারকাজের প্রবীণ শুরা সদস্য মাওলানা মোজাম্মেল হক।
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে প্রবীণ আলেম ও এ শুরা সদস্য মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা ছিলেন।
মরহুম মাওলানা মোজাম্মেল হক তাবলিগের বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণ আলেম ও শুরা সদস্য ছিলেন।
তাবলিগ জামাতের তৃতীয় বিশ্ব আমীর হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.)-কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় শুরার সর্বশেষ জীবিত সদস্য ছিলেন তিনি।
আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ
আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ গত ২৯ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের খতিব ও আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। প্রাজ্ঞ আলেম, সুবক্তা, চমৎকার কোরআন তেলাওয়াত ও মুফাসসিরে কোরআন হিসেবে মাওলানা আনোয়ার শাহ দেশব্যাপী পরিচিত ছিলেন।
সেজদারত অবস্থায় আল্লামা শাহ তৈয়বের ইন্তেকাল
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদ্রাসা আল জামিয়াতুল আরাবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরির মুহতামিম আল্লামা শাহ্ তৈয়ব ২৪ মে দিবাগত রাত দেড়টায় জায়নামাজে সেজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
৭৯ বছর বয়সী প্রবীণ এই আলেম বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ছিলেন। ৩৬ বছর তিনি জিরি মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইদ্রিস
চট্টগ্রাম নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইদ্রিস ২৭ মে, বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম ইন্তেকাল করেন। ২০০৪ সালে থেকে নাজিরহাট মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী
দেশের প্রবীণ রাজনীতিবীদ, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী ১১ মে রাত সাড়ে আটটায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি দৈনিক সরকার পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারী
নন্দিত মুফাসসিরে কোরআন মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারী ১৭ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বেড়তলা জামিয়া রাহমানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭০ বছর। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ। প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশ বিদেশে দ্বীনের প্রচারে কাজ করে গেছেন।