
গোয়াইনঘাট থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা:: প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলা ভূমি সিলেট। এই সিলেটের রয়েছে ছোটবড় অনেক পাথর কোয়ারী।এইসব পাথুরে রাজ্যে ঘাম ঝরিয়ে অর্থ উপার্জন করে থাকেন হাজারো শ্রমীকরা।
ভরা মৌসুমেও বন্ধ রয়েছে সিলেটের ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি, শ্রীপুর, লোভাছড়া।
কোয়ারীগুলোতে নেই শ্রমিকদের কন্ঠে পালা করে জারী সারী বাউল গানের সুরও। নেই পাথরবাহী ট্রাক্টর,ট্রাকের দীর্ঘ লাইন।
সবকটি পাথর কোয়ারীতেই যেন সুানসান নিরবতা। উচ্চ আদালতে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতি বেলার মামলার কারণে বিগত ২ মৌসুম থেকে সিলেটের জাফলংসহ সবকটি পাথর কোয়ারী থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। আইনগত কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব পাথর কোয়ারীতে কোন ধরণের পাথর-বালি উত্তোলন হচ্ছেনা। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে পরিবেশ বিপর্যয় আইনে পরিবেশ আইনবীদ সমিতি বেলার করা ঐ মামলার রায় হয় ২০১২ সালে।
এরপর জাফলং পাথর কোয়ারীর বৃহৎ অংশসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাকে ইসিএ (প্রতিবেশ সংকটাপন্ন) এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে জাফলং পাথর কোপাথর-বালি উত্তোলনসহ সব ধরণের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয় এবং ২০১৫ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। গেজেট প্রকাশের পর পরই জাফলং পাথর কোয়ারীর সব ধরণের অপারেশন বন্ধ হয়ে যায়। আর এ কারণে ২০১৮-১৯ মৌসুমসহ চলতি ২০২০ উত্তোলন মৌসুমেও বন্ধ আছে জাফলং পাথর কোয়ারীর সব ধরণের পাথর,বালি উত্তোলন প্রক্রিয়া। পরিবেশ জনিত কারণে আদালত নির্দেশিত জাফলং পাথর কোয়ারীর প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার বাহিরের অংশ বন্ধ করণের পাশাপাশি অপরাপর উপজেলা সমুহের পাথর কোয়ারী সমুহের পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। যে কারণে কোন পাথর কোয়ারীতে নেই পাথর উত্তোলনের সেই চিরচেনা কর্ম ব্যস্ততা।
বন্ধ অলস পড়ে আছে হাজার হাজার পাথরবাহি ট্রাক,ট্রাক্টর,নদীতে ঘাটে ঘাটে বাধা রয়েছে হাজার হাজার পাথরবাহি নৌকা। সিলেটের এসব পাথর কোয়ারীর উপর সুদীর্ঘকাল থেকে নির্ভরশীল লাখো শ্রমিক,ব্যবসায়ী। গোয়াইনঘাট,জৈন্তাপুর,কোম্পানিগঞ্জ,কানাইঘাটসহ সীমান্ত জনপদের সবকটি উপজেলার মানুষজন,ব্যবসা বানিজ্যও এসব পাথর কোয়ারীর আয়-রোজগারের উপর নির্ভর করে চলে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে। প্রতি বছর কৃষি আবাদে পাহাড়ি ঢল সৃষ্ট ফসলহানীর কারণে দীর্ঘকাল থেকেই কৃষিতে নিরুৎসাহিত রয়েছেন এলাকার মানুষজন। সরকারি,বেসরকারি চাকরি,ব্যবসা,প্রবাস নির্ভরতা কিংবা বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় এসব পাথর কোয়ারী ঘিরেই চলে আসছিলো সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা। পরিবেশের দোহাই দিয়ে আচমকা জাফলং, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, শ্রীপুর,লোভাছড়া সবকটি পাথর কোয়ারীর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে সিলেটের সবকটি পাথর কোয়ারী বন্ধ রেখে বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে পাথর। সিলেটের এসব পাথর কোয়ারী সমুহ বন্ধ হওয়াতে এখাতে সংশ্লিষ্ট লাখো শ্রমিক,ব্যবসায়ী,বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন বিপাকে। হুট করে বেকারত্মের মুখোমুখি হয়ে চরম অমানবিক পরিবেশে কাটছে তাদের জীবনজীবিকা। অভাব,অনটন আর ঋণের চাপে দিশেহারা হাজার হাজার পাথর ব্যবসায়ী। দু-বেলা দুমুটো ভাতের জন্য অসহায় অগণিত শ্রমিকদের আর্তনাত যেন দেখার কেউ নেই। বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে আইনী ও প্রশাসনিকভাবে তাদের কর্মসংস্থান বন্ধ করে দেয়ায় চরম অসন্তোষ চলছে গোটা উত্তর সিলেট অঞ্চল জুড়ে। কোয়ারী সমুহের পাথর বালি বন্ধ করে দেয়ায় নির্মাণ শিল্পের প্রধান কাচামাল পাথর নিয়ে উন্নয়ন কাজও ব্যয় বহুল হয়ে দাড়িয়েছে এবং সরকারও উত্তোলিত পাথর থেকে বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভোলাগঞ্জ,জাফলং,বিছনাকান্দি,শ্রীপুর,লোভাছড়ায় পাথর কোয়ারী খুলে দিতে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিল,প্রতিবাদ সমাবেশ মানববন্ধন হচ্ছে। পাথর কোয়ারী সমুহ থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের যৌক্তিক দাবি নিয়ে ৪টি উপজেলার অন্তত ৩০টি শ্রমিক,ব্যবসায়ী সংগঠন মাঠে রয়েছে।
সনাতন পদ্ধতিতে পাথর কোয়ারী সমুহ খুলে দেয়ার দাবিতে জোরালো হচ্ছে আন্দোলন সংগ্রাম। বুধবার সরজমিনে দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারী ভোলাগঞ্জ পরিদর্শনকালে দেখা যায় সর্বত্রই কর্মহীন মানুষের হাহাকার। আইনী জটিলতার কারণে ও প্রশসনিক বাধায় যান্ত্রিক পদ্ধতির পাশাপাশি সনাতন পদ্ধতির পাথর উত্তোলনও সম্পুর্নভাবে বন্ধ আছে। ভোলাগঞ্জ,গুচ্ছগ্রাম,দয়ার বাজার,কলাবালি,লিলাইর বাজারে নেই কোন কোলাহর। সর্বত্রই যেন শ^শানের নিরবতা নেমে এসেছে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বন্ধ থাকায় এক ধরণের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন এ খাতে জড়িত এখানকার হাজার হাজার শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। শত শত ষ্টোনক্রাশার মিল থাকলেও গুচ্ছগ্রাম থেকে শুরু করে কলাবাড়ি,পাড়–য়াসহ আশপাশের সবকটি ষ্টোন ক্রাশিংজোনগুলোতে পাথর ভাঙ্গার কোন চিহৃও পরিলক্ষিত হয়নি। সর্বত্রই যেন কর্মহীন বেকার মানুষের কাফেলা। পরিদর্শনকালে কথা হয় শ্রমিক,ব্যবসায়ীদের সাথে।
গুচ্ছগ্রাম এলাকার প্রতিষ্টিত পাথর ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ। তিনি জানান,আমি বিগত ২০ বছর যাবৎ পাথর ব্যবসায় জড়িত। আয় রোজগার ভালোই ছিলো,কিন্তু গত বছর থেকে কোন কারণ ছাড়াই আমাদের কোয়ারী অপারেশন সম্পুর্নরুপে বন্ধ রাখা হয়েছে। কোয়ারীতে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকার কারণে আমার প্রতিষ্টান বন্ধ রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের বিনিয়োগকৃত টাকাও মার খাচ্ছি। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় আমার চোখে অন্ধকার নেমে এসেছে।
পরিবার পরিজন নিয়ে কি যে কষ্টে দিনাতিপাত করছি তা বলে বুঝাতে পারবোনা। পাথর কোয়ারীর কার্যক্রম বন্ধ হওয়াতে সর্বোপুরি গোটা এলাকায় অভাব অনটন নেমে এসেছে। ইসলামপুর ইউনিয়ন বারকি শ্রমিক কল্যান সংগঠনের সভাপতি নুরুল ইসলাম জানান,ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীতে শ্রমিকের কাজ করে চলছিলো আমাদের হাজার হাজার শ্রমিক পরিবারের। এই কোয়ারীই আমাদের আয় রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। গত বছর থেকে হুট করে কোয়ারীর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ায় এলাকায় ঘরে ঘরে যেন দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে। অভাব অনটনের মুখোমুখি হাজার হাজার শ্রমিক পরিবারে যেন দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে। কোম্পানিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি শাব্বির আহমদ জানান,সিলেটের কোম্পানিগঞ্জে দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারী ভোলাগঞ্জ অবস্থিত। সেই পাথর কোয়ারীতে যান্ত্রিক পদ্ধতির অজুহাতে বন্ধ আছে সনাতন পদ্ধতির পাথর উত্তোলনও। এতে করে হাজার হাজার শ্রমিক- ব্যবসায়ী পরিবারে হাহাকার ছলছে। বেকারত্মের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উপজেলার আইনশৃখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে চুরি,ডাকাতি,ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরজমিনে জাফলং পাথর কোয়ারী ঘুরেও একই চিত্রও দেখা যায়। জাফলং পাথর কোয়ারীর নিষিদ্ধ ইসিএ এলাকা ছাড়াও কোথাও নেই কোন পাথর উত্তোলন প্রস্তুতি। সর্বত্রই প্রশাসনের নজরধারী,মোবাইলকোর্ট পরিচালিত হওয়াতে পাথর,বালি উত্তোলন বন্ধ রয়েছে।
ব্যবসায়ী ও মোহাম্মদপুর মিতালী সবুজ সংঘের সভাপতি রুবেল আহমদ জানান,পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দিয়ে আমাদের প্রতি চরম অমানবিকতার মুখোমুখি করে দেয়া হয়েছে। পাথর কোয়ারী বন্ধ জনিত কারণে আমাদের ব্যবসা গুটিয়ে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি এবং ব্যাংক ও এনজিও ঋণের কিস্তি চালাতে চরম হিমশিম খাচ্ছি। লন্ডন বাজারের বাসিন্দা শ্রমিকনেতা করিম আহমদ জানান,আইনী জটিলতার কারণে জাফলংসহ সবকটি পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় জাফলং পাথর কোয়ারীর হাজার হাজার খেটে খাওয়া শ্রমিক পরিবারে হাহাকার চলছে।
সম্প্রতি শেষ হওয়া ৬দফা বন্যায় ফসলহানীর পর মানবেতর জীবন যাপন করছে হাজার হাজার শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। তাদের কষ্টের যন্ত্রনা,আর্তনাদ যেন দেখার কেউ নেই। আমাদের কর্মসংস্থান খুলে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা দূর করে দিতে আমরা সরকারের প্রধানমন্ত্রির সুদৃষ্টি আকর্ষন করছি। জাফলং বল্লাঘাট পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন,আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
জাফলং পাথর কোয়ারীর নিষিদ্ধ ইসিএ এলাকার বাহিরে থাকা চৈলাখেল ও প্রতাপপুর মৌজার অবশিষ্ট অংশে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনে নির্দেশনা প্রদানে সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষন করছি। জাফলং ট্রাক চালক সমিতির সাবেক সভাপতি মোঃ ফয়জুল ইসলাম বলেন,জাফলংসহ সবকটি পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় পরিবহণ শ্রমিকরা কি পরিমাণ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তা মুখে বলে শেষ করা যাবেনা। মানবিক বিপর্যয়রোধে আমরা লাখো শ্রমিক,ব্যবসায়ীরা সরকারের প্রধানমন্ত্রির দিকে তাকিয়ে আছি।