অমিতাভ চক্রবর্ত্তী রনি:: ডাঃ গোপাল চক্রবর্ত্তী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় অবস্থিত বাঁশতলা ৫নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মীর শওকত আলী ও সাবসেক্টর কমান্ডার কর্নেল এ.এস. হেলালউদ্দিন এর নেতৃত্বে ডাক্তার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বাঁশতলা ৫নং সেক্টরে শুধু ডাক্তার হিসেবেই কর্মরত ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এই তথ্য সুনামগঞ্জের গর্ব, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক, সুনামগঞ্জের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আলোকিতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু মহোদয়ের ২০১২ সালে প্রকাশিত “রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ ‘নামক বইয়ের ৪৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু এর কাছ থেকে শোনা যায়, তিনি যখন মহান মুক্তিযুদ্ধে চেলা ও সীমান্তের রেঙ্গুয়া বাজারে যেতেন তখন ডাঃ গোপাল চক্রবর্ত্তী তাদেরকে প্রচুর সহযোগিতা করতেন। তারা তাকে গোপাল দা বলে ডাকতেন। তারা যখন খুব অসুস্থ হতেন তখন তাদের চিকিৎসার একমাত্র অবলম্বন ছিল ডাঃ গোপাল দা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ঔষধ সরবরাহ করতেন। এডভোকেট বজলুল মজিদ খসরু বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ” চরমপত্র” নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। এখনো মনে আছে, আমরা ভারতের রেঙ্গুয়া বাজারে দোয়ারাবাজারের গোপাল দার ফার্মেসিতে গিয়ে চরমপত্র অনুষ্ঠান শুনতাম। খুব মজা পেতাম। এম.আর.আখতার মুকুল অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। আমাদের প্রেরনার উৎস ছিল ” চরমপত্র”।
গোপাল দার একটি রেডিও ছিল। ঐ রেডিও এর মাধ্যমে তিনি সারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়, কিভাবে পাকিস্তানি হায়নাদের ব্রাশ ফায়ার এবং হত্যা করতেন তিনি এই তথ্য দিতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের শুকনো খাবার দিতেন। শরীর চাঙা রাখার জন্য রং চা খাওয়াতেন। যখন মুক্তিযোদ্ধারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ত তখন তিনি তাদেরকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিতেন। তাদের সাথে হাসি ঠাট্টা ও মজা করতেন। তিনি তাদের অনুপ্রেরণা দিতেন। তোমরা তোমাদের কাজ করে যাও। নিশ্চিত থাক কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা পাকিস্তানি হায়নাদের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারবো। শুধু ধৈর্য ধরে এগিয়ে যাও। মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধারা গোপাল দার কাছে আসতো নিজেদেরকে শানিত করার জন্য। গোপাল দা ছিল তাদের আস্থার জায়গা। কখনো উনার কাছ থেকে কোনো তথ্য ফাঁস হতো না । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মাঝামাঝি সময়ে তিনি রেঙ্গুয়া থেকে বাঁশতলা ৫নং সেক্টরে চলে আসেন। সেখানে তিনি সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মীর শওকত আলী ও সাবসেক্টর কমান্ডার কর্নেল এ.এস. হেলালউদ্দিন এর নেতৃত্বে ডাক্তার হিসেবে কৈতক হাসপাতালে কাজ করেছিলেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি মায়া ও মমতা দিয়ে সেবা করতেন। তিনি যে রেশন পেতেন তা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দিতেন। নিজে না খেয়ে অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে খাবার তুলে দিতেন। এভাবেই সাহায্য ও সহযোগিতা করতেন।
তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছিলেন তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকও ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য দোয়ারাবাজার -টেংরাটিলা-আশাউরা-কান্দাগাঁও- লিয়াকতগঞ্জ ইত্যাদি গ্রাম নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এডভোকেট বজলুল মজিদ খসরু এর প্রকাশিত “রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ ” বইয়ে এই কমিটির আংশিক রুপ পাওয়া গেছে তা নিম্নরুপ : সভাপতি হিসেবে ছিলেন দোয়ারাবাজারের এ.কে. এম আসকির মিয়া,সহসভাপতি আহসান উল্লাহ (ভাঙ্গাপাড়া),সদস্য সিরাজ মিয়া (কুমিল্লার লোক),মদনমোহন নন্দী(আশাউরা), উমেদ আলী মোড়ল (সোনাচূড়া) , ডা: আব্দুল হামিদ (টেংরাটিলা)। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে হাজী সোনাহর মিয়া (পশ্চিম মাছিমপুর), হারিছ মিয়া তালুকদার (দিঘলবন্দ),মোমিন উদ্দিন (দোয়ারাবাজার), সোনা মিয়া (পূর্ব মাছিমপুর), আব্দুল ওয়াহিদ (পশ্চিম মাছিমপুর), মোঃ ফজলুল হক (টেংরাটিলা),আব্দুল হক(টেংরাটিলা), সিরাজ মিয়া (বোগলা), মন্নান ফকির (বোগলা), আলফাজ মিয়া (বাগানবাড়ি), রুস্তম আলী (সোনাচূড়া), রুপা মিয়া (গোজাউরা), হাজী দাইম উল্লাহ(গোজাউরা), মনীন্দ্রচন্দ্র রায় (দোয়ারাবাজার) প্রমুখ উল্কার গতিতে কাজে নেমেছিলেন। ডাঃ গোপাল চক্রবর্ত্তীও তাদের সাথে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নিজের মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি দোসরদের কাছ থেকে রক্ষার জন্য অনেক কিছু আত্মত্যাগ করেছিলেন। তার চিন্তা-চেতনায় শুধুই ছিল দেশকে বাঁচাতে হবে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যে চেতনায় তারা উজ্জীবিত হয়েছিল সেই চেতনাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি তা-ই করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধাদের চিকিৎসা,খাবার,বিভিন্ন তথ্য দেয়া থেকে শুরু করে অনুপ্রেরণা সহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ডা: গোপাল চক্রবর্ত্তীর এই গুরুত্বপূর্ণ অবদান জাতির মনে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি দোয়ারাবাজারের কৃতি সন্তান হিসেবে তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন। মুক্তিযুদ্ধের নিবেদিত প্রাণ ও পরিশ্রমী সংগঠক ডাঃ গোপাল চক্রবর্ত্তী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এই প্রত্যাশা করি। জয় বাংলা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট