
সিলেটের বার্তা প্রতিবেদন:: গত ৩ দিন থেকে টানা বর্ষন আর পাহাড়ি ঢলে বন্যার পানি ক্রমশ: বাড়তেই আছে। সুনামগঞ্জ জেলা শহরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘটেছে অবনতী।
রবিবার সকাল ৬টায় সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৭০সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।দুপুর ১২টায় তা ৭ সেন্টিমিটার কমে ৬৩সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টি পাত রেকর্ড করা হয়েছে ২১৩মিলিমিটার।সন্ধ্যা ৬ টায় সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ শহরের প্রায় ৮০ভাগ বাড়ি ঘরে পানি প্রবেশ করে। অনেকের আঙ্গিণায় পানি থৈ থৈ করছে।শহরের অধিকাংশ সড়কেই যান্ত্রিক যানের পরিবর্তে চলাচল করছে নৌকা।ছাতক-গোবিন্দ গঞ্জ সড়কের মুফতির গাঁওয়ের ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনের সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলাম কবীর।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসীর হাসান পলাশ জানান, উপজেলার সব ইউনিয়ন প্লাবিত। তবে মধনগর, দক্ষিণ বংশী কুন্ডা, জয়শ্রী, সেলবরষ ও চামারদানি এই ৫টি ইউনিয়নের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের পাঠান পাড়া, গড়কাটি ,ও সোহালা বেরীবাধঁ হুমকির সম্মুখীন। স্থানীয় লোকজন এ গুলো মেরামত করছে। বাঁধগুলো ভেঙ্গে গেলে বাদাঘাট সহ অনেক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আমনের বীজ তলা তলিয়ে যাওয়ায় জমি চাষাবাদ ও বীজ বপন অনিশ্চিতের আশংকা করছেন কৃষকরা। জেলা প্রশাসকের বাসভবনের নীচতলা ও মরমী কবি হাসন রাজার মিউজিয়ামেও পানি উঠেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ জানিয়েছেন, জেলায় মোট ৭৮টি কনটরোলরুম খোলা হয়েছে। সকল ইউএনও দের সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।শুকনো খাবার আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান জানান, জেলার ১১টি উপজেলায় ১৬৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে, এতে ইতিমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে ১১৪৩ জন মানুষ।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল জানান, বন্যার সাথে সাথে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে শুকনো খাবার চিড়া, মুড়ি, গুড়, মোমবাতি, ম্যাচ ইত্যাদি দিয়েছি এবং তা অব্যাহত থাকবে। শহরের ধোপাকালী স্লুইস গেটের পাশের মাটি সরে গেলে সদর উপজেলার পক্ষ থেকে ও স্থানীয় লোকজনকে সাথে নিয়ে মেরামত করা হয়। এছাড়া সদর উপজেলার মঙ্গল কাটাবাজারের পাশের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে দোকান পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। খবর পেয়ে উপজেলা প্রকৌশলী ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ এলাকার মানুষের সহযোগিতায় বাঁধটি রক্ষা করা হয়।
ছাতক: সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে।রোববার পর্যন্ত ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় নতুন-নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে এখানের বহু রাস্তাঘাট, প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মৎস্য খামার। ছাতক-সিলেট সড়কের বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
তিনদিনের টানা প্রবল বর্ষন ও পাহাড়ি ঢলের কারনে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুই লক্ষাধিক মানুষ। গত ২৪ ঘন্টায় এখানে ১৩০ মি.মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমার ১৭৬সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধির ফলে পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও হাটবাজার বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। গ্রামীণ সড়ক প্লাবিত হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ছাতক-সিলেট সড়কের বিভিন্ন অংশ।এতে সড়ক পথে ঝুঁকি নিয়ে কিছু কিছু যান চলাচল করলেও শনিবার রাত থেকে ছাতকের সাথে জেলা সদরসহ দেশের সকল অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন নিরাপদ স্থানে।
স্থানীয়রা জানান, অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ও নোয়ারাই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিন-রাত অতিবাহিত করছেন।
ছাতক শহর, ছাতক সদর, কালারুকা, চরমহল্লা, জাউয়াবাজার, দোলারবাজার, ভাতগাঁও, উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, সিংচাপইড়, গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও, ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
ছাতক-দোয়ারা, ছাতক-সুনামগঞ্জ, ছাতক-জাউয়া সড়কের বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইসলামপুর ইউনিয়নের ছনবাড়ি-রতনপুর সড়ক, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট সড়ক, কালারুকা ইউনিয়নরে মুক্তিরগাঁও সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়ক, আমেরতল-ধারণ সড়ক, পালপুর-সিংচাপইড় সড়ক, বোকারভাঙ্গা-মানিকগঞ্জ সড়কসহ উপজেলার বিভিন্ন সড়কের একাধিক অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
একাধিক স্টোন ক্রাসার মিল, পোল্ট্রি ফার্ম ও মৎস্য খামারে বন্যার পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শাক-সবজির বাগানেও পানি প্রবেশ করায় ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এছাড়া ইসলামপুর ইউনিয়নের রতনপুর, নিজগাঁও, গাংপাড়, নোয়াকোট, বৈশাকান্দি, বাহাদুরপুর, ছৈদাবাদ, রহমতপুর, দারোগাখালীসহ অন্যান্য গ্রাম, পৌরসভার হাসপাতাল রোড, শাহজালাল আবাসিক এলাকা, শ্যামপাড়া, মোগলপাড়া তাতিকোনা, বৌলা, লেবারপাড়া নোয়ারাই ইউনিয়নের বারকাহন, বাতিরকান্দি, চরভাড়া, কাড়–লগাঁও, লক্ষীভাউর, চানপুর, মানিকপুর, গোদাবাড়ী, কচুদাইড়, রংপুর, ছাতক সদর ইউনিয়নের বড়বাড়ী, আন্ধারীগাঁও, মাছুখালী, তিররাই, মুক্তিরগাঁও, উত্তর খুরমা ইউনিয়নের আমেরতল, ঘাটপার, গদালমহল, রুক্কা, ছোটবিহাই, এলঙ্গি, রসুলপুর, শৌলা, চরমহল্লা ইউনিয়নের ভল্লবপুর, চুনারুচর, চরচৌলাই, হাসারুচর, প্রথমাচর, সিদ্ধারচর, চরভাড়–কা, দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের হরিশরণ, হাতধনালী, রাউতপুর, ধনপুর, চৌকা, রামচন্দ্রপুর, হলদিউরা কালারুকা ইউনিয়নের রামপুর, মালিপুর, দিঘলবন, আরতানপুর, রংপুর, মুক্তিরগাঁও, ভাতগাঁও ইউনিয়নের জালিয়া, ঘাঘলাজুর, হায়দরপুর, বাদে ঝিগলী, সিংচাপইড় ইউনিয়নের পুরান সিংচাপইড়, আসলমপুর, গহরপুর, মহদী, সৈদরগাঁও, সিরাজগঞ্জ বাজার, সরিষাপাড়া, হবিপুর, মামদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গোলাম কবির জানান, ইতোমধ্যে বন্যা দুর্গতদের আশ্রয়ের জন্য নোয়ারাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাতিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চন্দ্রনাথ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আরো ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য প্রস্তত করা হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় মেডিকেল টিম গঠনসহ সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।