সিলেটের বার্তা ডেস্ক:: মহামারী করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতি ত্রাণ চেয়ে এমপির মামলার গ্যারাকলে পড়লেন এক শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
এমন পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে ফোন দিলে গোপনে খাদ্য সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সংসদ সদস্য শাহনওয়াজ মিলাদ গাজী। গত ৭ এপ্রিল তিনি ফেসবুকে এ ঘোষণা দেন। এরপর কয়েকটি গণমাধ্যমেও মাধ্যমে নিউজ হয়। আর এ বিষয়টি জানতে পেরে নবীগঞ্জের ৫ নং আউশকান্দি ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের পাহাড়পুর গ্রামের কয়েকজন মানুষ ফোন দেন। এরপর প্রায় সপ্তাহ-খানেক অপেক্ষা করেও ত্রাণ পাননি এসব মানুষ। এরপর তারা এলাকার বিভিন্ন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন।
এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সবাই এমপির সাথে যোগাযোগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ এপ্রিল উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল্লা রুহেল ‘ফোন করলেই ঘরে পৌঁছে যাবে খাবার, আমার জানা মতে, অনেকেই ফোন দিলো কিন্তু কারো ঘরে, আজও খাবার পৌঁছে নাই, ব্যাপার কি?’ লেখে একটি পোস্ট করেন। আর হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী মো. জাকির হোসাইন ফেসবুকে গত ১ মে ত্রাণের নামে নোংরা রাজনীতি বন্ধ করুন শিরোনামে একটি পোস্ট লেখেন। পোস্টে তিনি ফোন দিয়েও ত্রাণ না পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
এরপর গত ১ মে রাত ১০ টা ২২ মিনিটে এমপি মিলাদ গাজীর পিএস (মিডিয়া) মুহিবুর রহমান ছাত্রলীগ নেতা জাকির হোসাইনের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ও ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দিয়ে ত্রাণ সংকটের কথা বলে ৫/৬ প্যাকেট ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু সেই ত্রাণ আর পৌঁছেনি বলে অভিযোগ করেছেন মো. জাকির হোসাইন।
এরপর সকল আলোচনা সমালোচনা থেমে গেলেও থামেননি এমপি মিলাদ গাজী। তিনি পোস্ট ডিলিট করার জন্য বিভিন্ন ভাবে এসব নেতাদের চাপ প্রয়োগ করেন। সবশেষ গত ৫ মে (মঙ্গলবার) বিকেলে এমপির হয়ে কোতোয়ালী থানার লামাবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ কামাল হোসেন ছাত্রলীগ নেতাদের ফোন দিয়ে গালিগালাজ করেন। এক পর্যায়ে তিনি পোস্ট ডিলিট করার কথা ও এমপি মহোদ্বয়ের সাথে সমঝোতা করার পরামর্শ দেন।
এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের (এমপি বলয়ের) কয়েকজন নেতাকর্মীর অনুরোধে তারা পোস্ট ডিলিট করেন। এরপর ৭ মে বৃহস্পতিবার এমপি শাহনওয়াজ মিলাদ গাজীর ব্যক্তিগত কম্পিউটার অপারেটর অলিউর রহমান ইমরান বাদি হয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জাকির হোসেন, গিয়াস উদ্দিন মামুন ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল্লা রুহেলের বিরুদ্ধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫(২)/২৯(১)/৩১(২)/৩৫ ধারায় মামলা দায়ের করেন।
এর আগে বুধবার ৬ এপ্রিল আড়াইটার দিকে ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজারের একটি পেট্রোল পাম্প থেকে গিয়াস উদ্দিন মামুন নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এদিকে ফোন দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কোতোয়ালী থানার লামাবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ কামাল হোসেন বলেন, আমার কাছে এমপি মিলাদ গাজী সাহেবের ভাই শাহেদ গাজী সাহেব আমার কাছে এসে পোস্টের বিষয়টি জানানা। পরে আমি জাকির নামের একজনকে ফোন দিয়ে বিষয়টি সমাধানের জন্য বলি। এর বেশি কিছু নয়।
আর হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন, নবীগঞ্জ-বাহুবল উপজেলার মধ্যবিত্ত যে সকল পরিবার খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে আছেন। তাদেরকে গোপনে খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে জানিয়ে এমপির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট দেয়া হয়। পরে অনেকে এমপি মহোদয়ের কাছে ত্রাণ চাইলেও তিনি পৌঁছে দেননি। পরে লোকজন ত্রাণ না পেয়ে তার সাথে যোগাযোগ করে। তিনি সংসদ সদস্যের সাথে কথা বললে তিনি তার মিডিয়া পিএস মাহিবুরের সাথে কথা বলতে বলেন। মাহিবুর গভীর রাত অবধি দরিদ্র লোকজনকে অপেক্ষা করতে বলে ত্রাণ নিয়ে রওয়ানা হয়েছে মর্মে জানায়। রাত পেরিয়ে সকাল হলেও ত্রাণ নিয়ে আসা হয়নি। দারিদ্র লোকজন সারা রাত নির্ঘুম অপেক্ষা করেও ত্রাণ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। এই বিষয়টি ফেসবুকে তুলে ধরা হয়।
অন্যদিকে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সংসদ সদস্য শাহনওয়াজ মিলাদ গাজী বলেন, সমালোচনা করতো কেন? পারলে হে এক কেজি দেউক। আমি তো চাউল দিরাম, ডাল, তেল, আলু, সাবান দিরাম। আমি তো আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে দিরাম। আর ফেসবুকে এটা নিয়ে সমালোচনা করতো কেনে? আর আমি আওয়ামী লীগের এমপি আমার বিরোধিতা করে। কইছি যেই হোক তারে একশন হউক।
তবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ত্রাণ নিয়ে গেলেন না কেন জানতে চাইলে এমপি আরও বলেন, ত্রাণ নিয়ে গেছেন। তবে তাদের কাউকে আমরা পাইনি। আমি আমার ছেলেকে ইন্ডিয়া রেখে এসেছি। আমি ৬ হাজার মানুষকে ত্রাণ দিয়েছি। আগামী কিছুদিনের মধ্যে আরও ১ হাজার ত্রাণ বিতরণ করা হবে। আর আমি আমার মতো করে দিবো, আমি ‘বাউন্ট’ নায়। এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন নেই। আর একজন আমাকে ম্যানশন করে লিখেছে। আমার ধারণা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। তবে আই ডোন্ট কেয়ার ইট।
আর নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর জাহান চৌধুরী বলেন, আমাদের এমপি নামে আমাদের অভিভাবক। কিন্তু তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের এড়িয়ে চলছেন। যদি আমাদের উপজেলার কোন নেতাকর্মী ভুল করে তাহলে তিনি অভিভাবক হিসেবে ডেকে নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। তিনি এটা না করে পুলিশি হয়রানি করছেন। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল আইনে মামলার বিষয়টি শুনেছি। এটি অত্যন্ত দু:খজনক। এখানে দলের বিষয় নায়। আর কি লিখছে সেটা আমি দেখিনি। আর এ লেখায় ডিজিটাল আইনে মামলা হয় না কি না? আমি এটাও জানি না। আর জনপ্রতিনিধি হিসেবে যেহেতু তিনি লিখেছেন খাদ্য দিবেন সেজন্য মানুষ চাইতেই পারি।
তিনি আরও বলেন, একজন সংসদ সদস্যর কাছে সবাই হয়তো সাহায্য চাইবে। তিনি দিতে না পারলে বুঝিয়ে বলছেন। কিন্তু এখন যেটা হয়েছে সেটা বিশ্রি ব্যাপার।
নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান জানান, সংসদ সদস্য শাহ নেওয়াজ মিল্লাদ গাজী বিরুদ্ধে ফেসবুকে মিথ্যা স্ট্যাটাস পোস্ট দেয়ার জেরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।