
মুফতি মাওলানা জিয়াউর রহমান, অতিথি লেখক বিশ্বকাঁপানো গায়েবি এক ভাইরাস করোনা। এই ভাইরাসটি দীর্ঘ চার মাস যাবত পুরো দুনিয়াকে থমকে দিয়েছে। মহান আল্লাহর ‘কুন=ফাইয়াকুন’ এর ইশারায় চলছে সবই।
এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে, বাঁচাতে বিশ্বের জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা নানা পথ-পন্থা অনুসন্ধানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে মসজিদসমূহে মুসল্লির উপস্থিতি একটা নির্ধারিত সংখ্যার মাঝে আনা হয়েছে। এর কারণে মুসলমানের হৃদয় কেঁদেছে। মসজিদ উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। অবশ্যই ইতোমধ্যে খুলে দেয়ার অনুমতিও এসে গেছে।
রমজানুল মোবারক আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন রহমত স্বরূপ। রমজান হচ্ছে আত্ম সংযমের মাস। ধর্য্যশীলতার মাস। রমজানের অন্যতম একটি শিক্ষা হচ্ছে সংযম। এবার করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, তৈরি হয়েছে ভিন্ন আবহ। বিশ্ব পরিস্থিতির অবস্থা থমথমে। অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে সবাই আতঙ্কিত।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য হোম কোয়ারেন্টিনে থেকে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের কাছে বেশি বেশি করে দোয়া করা আমাদের দায়িত্ব। দেশ-জাতি সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আমাদের দোয়া করা উচিত। সেই সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘর থেকে বের না হওয়াটাও এক ধরনের সংযম।
যেহেতু এই পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মহামারিকালে ঘর থেকে বের না হওয়ার কথা হাদিসের মধ্যেও আছে। রাসুলে পাক্ (স.) বলেছেন, কোনো এলাকার মানুষ যদি মহামারিতে আক্রান্ত হন বা কোনো এলাকায় যদি মহামারি দেখা দেয় তাহলে ওই স্থানের লোকজন এলাকা ছেড়ে বাইরের এলাকায় বের হবে না। আবার বাইরের এলাকার লোকজন ওই এলাকায় প্রবেশ করবে না, এটা আল্লাহর রাসুলের নির্দেশ।
তাছাড়া আরেকটি হাদিসে আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, কোনো এলাকার মানুষ যদি মহামারিতে পতিত হয়। তারা যদি আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে এবং সওয়াবের আশায় যা কিছু হয়, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হয়। এই বিশ্বাস তথা ইমান-আক্বিদা লালন করে যদি কেউ তার ঘরের ভেতরে অবস্থান নেয়। সে মারা যাক অথবা না যাক আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন।
সুতরাং রমজান মাসে এই পরিস্থিতিতে ত্বাক্ওয়া অর্জনের আরও বেশি সুযোগ এসেছে। কারণ আমরা বিশ্বের সব মানুষ কিন্তু মৃত্যু ভয়ে কাতর হয়ে আছি। যত বড় সাহসী মানুষই হোক, মৃত্যু ভয় তাকে কাবু করতে পারে। আমরা মরণের ভয়ে আছি, আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের নৈকট্যের আরও বেশি সুযোগ এসেছে।
অন্য বছরের চেয়ে এবার পরিস্থিতির কারণে আল্লাহ তায়ালার ভয় আমাদের মনে জাগ্রত করতে বাধ্য করেছে। এই বিষয়গুলো আমাদেরকে খেয়াল রাখা দরকার। কারণ রমজানুল মোবারকের প্রতিটি মুহূর্ত দোয়া কবুলের সময়। প্রতিটা মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করেন।
সুতরাং এই সময়ে সমগ্র মানব জাতির জন্য আমরা দোয়া করবো, আল্লাহ তায়ালা যেন এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের মুক্তি দেন। আমাদের গুনাহ, পাপাচার, অশ্লিলতার কারণে আল্লাহ আমাদের এই আজাব আর গজব দান করেছেন। তাই আমাদেরও প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে দেন, তাহলে ভবিষ্যত জীবনে আমরা যেন গুনাহে জড়িত না হই। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নাফরমানি, বিদ্রোহের সামিল হয় এমন কোনো কাজে আমরা জড়িয়ে না পড়ি। যেমন বিশ্ববাসী সকলেই কিন্তু এখন নিজেদের সংশোধনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আগে মসজিদে আসতো না। এখন বলছে, আল্লাহ যদি আমাদের পরিবেশ তৈরি করে দেন তাহলে আমি আর মসজিদ ছাড়বো না। মানুষের ভেতরে একটা ভয়, ত্বাক্ওয়া জাগ্রত হচ্ছে। তাই এই মাসে আমাদের আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হবে।
আর এই পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অভাবের মধ্যে আছে। খেতে পারছে না, ইফতারের ব্যবস্থা নেই। অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমাদের মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে হতদরিদ্রদের পাশে যেতে হবে। যাদের সামর্থ আছে, তারা আশপাশের মানুষজনকে সহযোগিতা করবো। যাদের ওপর যাকাত ফরজ হয়, তারা উদার চিত্তে যাকাত দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবো, কষ্টগুলোর অংশীদার হবো। আমরা রমজান মাসে সামর্থবানরাসহ সকলেই উপবাস থাকি। রমজান মাসে একমাস সিয়াম পালন করে তাদের অবস্থা উপলব্ধি করেন যারা সারা বছর যারা উপবাস করে। তাদের কষ্টগুলো অনুভূতিতে জাগ্রত করে দেয় মাহে রমজান।
এছাড়া মানুষের অভাব, সংকটকে পুঁজি করে যারা বাড়তি মুনাফা করে, মজুদদারি (গুদামজাত) করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে কষ্টে পতিত করে। তাদের প্রতি আল্লাহর রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন- তারা অভিশপ্ত, লা-নত প্রাপ্য।
তাই তাদের বোঝা দরকার, আল্লাহ তায়ালা যেকোনোভাবে আমাদের এই কষ্টের মধ্যে ফেলতে পারেন। এমনিতে মানুষ দুর্ভোগে আছে, তারপর আমাদের কর্মের দ্বারা যেন মানুষ দুর্ভোগের মধ্যে না পড়ে। যেকোনো মানুষকে কষ্ট দেওয়া জায়েজ না, এটা ইসলাম সমর্থন করে না।
মহামারিকালে বা কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষজন নিজেদের হেফাজতে ঘরে থাকে। তখন জীবন বাজি রেখে যারা মানুষের সেবা করেন, তারা জাতির শ্রেষ্ট সন্তান। ঠিক তেমনই এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা বিপদগ্রস্থ মানুষকে চিকিৎসা দিতে নিজের জীবন এমনকি পরিবারকে ঝুঁকিতে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। তাদের প্রতি পুরো জাতির কৃতজ্ঞ থাকা এবং দোয়া করা প্রয়োজন।
ইসলাম সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। মসজিদে এসে নামাজ আদায় করা সুন্নতে মোয়াক্বাদা। কেউ কেউ বলেছেন ওয়াজিব। এই পরিস্থিতিতে উলামায়ে ক্বেরাম ব্যাখা দিয়েছেন, যখন অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে যাবে তখন ঘরে নামাজ আদায় করতে পারবেন। একদা মদীনায় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল, আল্লাহ রাসুল (স.) তখন ঘরে আজানের সময় নামাজ আদায় করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাছাড়া মসজিদে নামাজ না পড়ার আফসোস বা অনুভূতি নিয়ে কেউ যদি ঘরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নামাজ আদায় করে, তবুও মসজিদে এসে নামাজ আদায়ের সওয়াব পাবে। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা যেন তাড়াতাড়ি মসজিদে নামাজ আদায়ের সুযোগ করেন দেন।
করোনার কারণে মসজিদে ইমাম ও মুসল্লিদের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতা আসছে। বড় বিষয় হচ্ছে মুসল্লিরা মসজিদে আসতে না পারা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে বড় একটা শাস্তি। এ থেকে উত্তরণের চেষ্টায় তওবা করতে হবে। হয়তো আমরা আল্লাহ তায়ালার ঘরের হক নষ্ট করেছি। আল্লাহ তায়ালা মসজিদ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। কেননা, একসাথে সারা বিশ্বে এভাবে লকডাউন কখনো হয়নি। পূর্বেও মহামারি হয়েছে, তবে সারা দুনিয়া জুড়ে এরকম পরিস্থিতি হয়নি। অবশ্য কেয়ামতের আগে ইমাম মাহদী ও দাজ্জালের আবির্ভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি হবে রাসুলে করিম (স.) বর্ণনা করে গেছেন। এটা কেয়ামতের আলামতের একটা অংশ। তাই এখন জানমালের হেফাজত থেকে ইমানের হেফাজত করতে হবে। আর ইমান শক্তিশালী করতে গেলে আমল করতে হবে।
সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে মসজিদগুলো উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে৷ এখানে উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে৷ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে মুসল্লিদের সচেতন করা কিন্তু উলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷
আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর রহমতের দরোজাগুলো আমাদের জন্যে উন্মুক্ত হচ্ছে৷ আমাদের অসচেতনতার কারণে যেন আবারও বন্ধ না হয়৷ তাই খুব সচেতন থাকতে হবে৷ আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল রাখতে হবে৷ তাঁর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে৷