অর্থনীতি বার্তা:: করোনার পরিস্থিতির মাঝে এমনিতেই সর্বসাধারণ পেরেশান এর মাঝে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা মেতে উঠেছেন কারসাজিতে।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা ২৫০-৩০০শ’ এমনকি সাড়ে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত দামে আদা বিক্রি করছেন। এমনটাই সরেজমিন ঘুরে দেখা সুনামগঞ্জ জেলা শহরে।
সুনামগঞ্জে বাজারে আদার দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি আদা কিনতে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। করোনা পরিস্থিতি ও রমজানের দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করে সুযোগ নিচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ি।
৪-৫ দিন আগেও যে আদা প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় কিনেছেন ক্রেতারা কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই আদাই দ্বিগুন দামে কিনতে হচ্ছে তাদের।
জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে সহকারি পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আমরা প্রতিদিনই বাজারে অভিযান পরিচালনা করছি। সোমবার র্যাবের সহযোগিতা নিয়ে জাউয়া বাজারে আদার মূল্যবৃদ্ধি ও মেয়াদউত্তীর্ণ দ্রব্য বিক্রি করার দায়ে ৫ টি প্রতিষ্ঠানকে ২৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অচিরেই বাজার নিয়ন্ত্রণে শহরে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এদিকে ৩২ সিন্ডিকেটে বন্দী হয়ে আছে এই আদা। এমন তথ্য উঠে এসেছে চট্রগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক এমন এক সিন্ডিকেটের তথ্য মিলেছে জেলা প্রশাসনের অনুসন্ধানে। এই সিন্ডিকেটে আছেন আমদানিকারক, ব্রোকার, কমিশন এজেন্ট ও আড়তদাররা। যার প্রমাণও ইতোমধ্যে পেয়েছেন জেলা প্রশাসন। এরা সবাই দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ব্যবসা করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আদার দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলেন আজিজ, সিরাজ, কাদের ও জিয়াউর রহমান। ২০১৯ সালে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। তিনি পেঁয়াজ ও আদার আমদানিকারকও। খাতুনগঞ্জের হাজি সোনা মিয়া মার্কেটে তার প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ইতোমধ্যে তিনিসহ অন্য সদস্যরাও গা ঢাকা দিয়েছেন। ফলে অভিযোগের কোনো জবাব তাদের কাছ থেকে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সরকারি হিসাবে চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৩২ জন আমদানিকারক ৩৫টি চালানে তিন হাজার ১৪৪ টন আদা আমদানি করেছেন। এর মধ্যে খাতুনগঞ্জের ফরহাদ ট্রেডিং ও মেসার্স ইউনিভার্সেল এগ্রো করপোরেশন, জুবিলি রোডের ওকেএম ট্রেডিং করপোরেশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কাস্টমসের ছাড়পত্রসহ এতে আমদানি খরচ পড়েছে ২৫ কোটি ২৬
লাখ ১৭ হাজার ৫৫ টাকা। এ হিসাবে প্রতিকেজি আদার গড় আমদানি খরচ পড়েছে ৮০ টাকা ৩৫ পয়সা। পরিবহন খরচসহ ধরলে প্রতিকেজি আদার দাম সর্বোচ্চ ৯০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু করোনাভাইরাস ও রমজানে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় এ সুযোগকে কাজে লাগান ৩২ জন আমদানিকারক।
গত ১৫ এপ্রিল থেকে সিন্ডিকেটটি এক দিনের ব্যবধানে চার দফায় আদার দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন। প্রথম তারা প্রতিকেজি আদা বিক্রি করেন ১০০ টাকা। পরের দিন ১২৫ টাকা; তারপর ২৫০ টাকা এবং পরে তা নিয়ে যায় ৩৬০ টাকায়। মার্চের শেষ সপ্তাহেও খাতুনগঞ্জে প্রতিকেজি দেশি আদা ৬০ থেকে ৭০ টাকা, মিয়ানমারের আদা ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং চীনের আদা ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেও পাইকারিতে প্রতিকেজি চীনা আদার দাম ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা।
বন্দরে আদা আসার পর আমদানিকারকদের কাছ থেকে নিয়ে ব্রোকার ও কমিশন এজেন্টরা তা খাতুনগঞ্জের আড়তদারদের কাছে পৌঁছে দেন। এভাবে এক হাত হয়ে অন্য হাতে পৌঁছতে আদার দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের পরস্পরের যোগসাজশে বন্দর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্র পার হতে গিয়ে দাম কয়েকগুণ বাড়ানো হয়। দাম বাড়ানোর পেছনে ব্যবসায়ীরা যেসব অজুহাত দেখিয়েছেন সেগুলোর সঙ্গে তাদের নথিপত্রের কোনো মিল না থাকার প্রমাণ পেয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন সমকালকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী রমজানে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দিয়েছেন। তার পরও অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট কারসাজি করে আদার দাম বাড়িয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। তাদের যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকলেও করোনার মধ্যেই বন্দর দিয়ে রমজানের পর্যাপ্ত পণ্য আসায় কোনো পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। কেউ কারসাজি করে দাম বাড়ালে প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
খাতুনগঞ্জে সরেজমিন পরিদর্শন করে ও নথিপত্র ঘেঁটে আদার ক্রয় মূল্যের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের অনেক বড় ব্যবধানের প্রমাণ পান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, ‘৩২ জনের সিন্ডিকেটটি কারসাজি করে আদার দাম অনেকগুণ বাড়িয় দিয়েছে। করোনাভাইরাস রোধে আদা চায়ের উপকারিতা নিয়ে প্রচার থাকায় সিন্ডিকেটটি এক দিন পর পর দাম বাড়াতে থাকে। চার দফায় বাড়িয়ে প্রতিকেজি আদার দাম ৩৬০ টাকায় নিয়ে যায় তারা। আমদানিকারকরা কমিশন এজেন্ট আর দালালদের মাধ্যমে সরাসরি বন্দর থেকে আদা আড়তদারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। যে কারণে খাতুনগঞ্জের একজন আড়তদারও আমাদের রশিদ দেখাতে পারেনি। আমদানিকারকরা আড়তদারদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেই দাম বাড়িয়েছে। কারসাজির সঙ্গে জড়িত ৩২ জনকে আটকে অভিযান অব্যাহত আছে।’
গতকাল খাতুনগঞ্জে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রির প্রমাণ পায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কয়েক লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়েছে। রোববার কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রি করায় খাতুনগঞ্জের কামাল উদ্দিন ব্রাদার্সকেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
চার প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ টাকা জরিমানা :গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় পান-সুপারির গোডাউনে লুকিয়ে রাখা ১২ টন আদা উদ্ধার করা হয়। ৮৮ বস্তায় রাখা এসব আদা বেশি দামে বিক্রির জন্য গোপনে মজুদ করা হয়। এ অপরাধে আড়তদার তৈয়ব আলীকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ক্রয়মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রির অপরাধে খাতুনগঞ্জের মাহবুব খান সওদাগরকে এক লাখ এবং একতা ট্রেডার্স ও শাহাদাত ট্রেডার্সকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম জানান, জরিমানা করা চারজন আড়তদার আমদানিকারক আজাদ সিন্ডিকেটের লোক। তাদের আমদানি লাইসেন্স বাতিল করতে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেব।
ক্যাবের উদ্বেগ :করোনার এমন দুঃসময়ে আদা নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অভিযুক্ত অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে লঘুদণ্ডের কারণে এ মূল্যসন্ত্রাসীরা করোনা মহামারির এ মহাদুর্যোগকালেও আদার দাম নিয়ে নৈরাজ্য করছে। হাজার টাকা জরিমানার মতো লঘুদণ্ড না দিয়ে তাদের দোকান বন্ধ, কারাদণ্ড, লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।’