আজ বুধবার, ৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, রাত ৮:৪১

করোনাভাইরাস: আতঙ্কের কারণ নেই

সিলেটের বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত মার্চ ৯, ২০২০, ১০:১৮ অপরাহ্ণ
করোনাভাইরাস: আতঙ্কের কারণ নেই

মোস্তফা সোহেল হিলালী:: প্রত্যেক মুমিন এই বিশ্বাস লালন করেন যে, পৃথিবীতে যত রোগ রয়েছে সকল রোগের সৃষ্টিকারী আল্লাহ তা‘আলা। কাউকে পরীক্ষা ও কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা রোগ বালা দিয়ে থাকেন।

প্রতিটি মুমিন এও বিশ্বাস করেন যে, রোগ থেকে মূলত আল্লাহ তাআলাই মুক্তি দান করেন। প্রতিমাদের অসন্তুষ্টিতে রোগ-বালা আসে এমন বিশ্বাস খন্ডন করে ইবরাহীম আ. বলেন, “আমি রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন।” (শু’আরা: ৮০)
প্রত্যেক ঈমানদারকে এও বিশ্বাস রাখতে হবে যে, রোগের মাঝে সংক্রমণ ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ত এবং তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার হুকুমেই একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমণ করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছাড়া কোনো রোগ ছড়াতে পারে না। রাসূল সা. বলেন, “রোগের কোনো সংক্রমণ নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসে কোনো অশুভ নেই।” (সহীহুল বুখারী, কুষ্টরোগ অধ্যায়)
তবে আল্লাহ তা‘আলা রোগের মাঝে সংক্রমণ ক্ষমতা রেখেছেন এবং তা তাঁর হুকুমে সংক্রমণ করতে পারে। তাই যেসব রোগে আল্লাহ তা‘আলা সংক্রমণ ক্ষমতা রেখেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে সেসব রোগ থেকে দূরে থাকা ও সতর্কতা অবলম্বন করা ঈমানের সাথে বিরোধ নয়, বরং তা শারীআতে কাম্য। রাসূল সা. বলেন, “কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো যেমন সিংহ থেকে দূরে থাকো।”(সহীহুল বুখারী, কুষ্টরোগ অধ্যায়)
মুমিনকে এও বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে যে রোগই দিয়েছেন তিনি তার জন্য শিফা বা নিরাময়ের ব্যবস্থা রেখেছেন। রাসূল সা. বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা এমন কোনো রোগ অবতরণ করেননি যার তিনি শিফা (আরোগ্য ব্যবস্থা) অবতরণ করেননি।” (সহীহুল বুখারী, আল্লাহ যে রোগই অবতরণ করেছেন তার জন্য শিফা অবতরণ করেছেন অনুচ্ছেদ)
আরেকটি হাদীসে রাসূল সা. বলেন, “প্রতিটি রোগেরই ঔষধ রয়েছে। যখন রোগের যথাযথ ঔষধ প্রয়োগ করা হয় আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে সেই রোগ ভালো হয়।” (সহীহ মুসলিম, সালাম অধ্যায়, প্রতিটি রোগের চিকিৎসা রয়েছে অনুচ্ছেদ)
উপরের বিষয়গুলোকে চিন্তায় রেখে এবার আমরা বর্তমান সময়ের মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত রোগ করোনা ভাইরাসের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলে দেখবো যে, করোনা একটি রোগ। আল্লাহ তা‘আলা এই রোগ দিয়েছেন। রোগটি একটি সংক্রামক ব্যধি বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এই রোগ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা আমাদের জন্য করণীয়। তবে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম ছাড়া এই রোগ কারো থেকে কারো শারীরে ছড়াতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা সকল রোগের যেমন চিকিৎসা রেখেছেন, তেমনি চিকিৎসা রেখেছেন এই রোগেরও। হয়ত চিকিৎসাটি আবিস্কার হতে দেরী হচ্ছে। চিকিৎসা আবিস্কার হলেই রোগটির ঔষধ যখন যথাযথ পড়বে তখন আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে অবশ্যই এই রোগ ভালো হবে।
একজন মুমিন হিসেবে এর চেয়ে অধিক আতঙ্ক বা হতাশার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মানুষের দুর্বলতা এই যে, তারা নতুন কোনো রোগ দেখলেই অধিক হতাশ ও অস্থির হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যাদের ঈমান নেই তারা মৃত্যুকে কঠিন ভয় পায়। এই কঠিন ভয়ের অস্থিরতাই বিষয়টিকে আমাদের কাছেও এমনভাবে প্রচার প্রসার করিয়েছে, যা একজন মুমিনের ঈমানকে দুর্বল ও দোদুল্যমান করে তুলছে। এই রোগ থেকে আশ্রয়ের জন্য মানুষ প্রধান আশ্রয়স্থল আল্লাহ তা‘আলা। করোনার ভয়ে আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয়ে যাওয়ার পথকে বন্ধ বা সঙ্কুচিত করা আমাদের ঈমানের কমতির লক্ষণ।
পৃথিবীতে যে রোগই প্রথমে প্রকাশ পেয়েছে তা স্বাভাবিকতই মানুষের মনে কিছু অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এক সময় শোনা যেতো, “যক্ষা হলে রক্ষা নেই”, এমন শ্লোগান ঈমানের দুর্বলতার পরিচয় হলেও আমরা এই শ্লোগান দিয়েছি বা শুনেছি। আলহামদুলিল্লাহ, এখন সেই শ্লোগান পাল্টে হয়েছে “যক্ষা হলে ভয় নেই”, “যক্ষা হলে রক্ষা আছে”। করোনার চেয়ে যক্ষা আরো মারাত্মক ব্যধি ছিলো। তাছাড়া পূর্বেকার কলেরা, ডায়রিয়া, প্লেগ ইত্যাদি মহামারির ভয়াবহতা শুনে গাঁ শিউরে উঠে। একেক গ্রামে এসব রোগ হানা দিয়ে অনেকের প্রাণ কেড়ে নিতো। কোনো পরিবারের সবার প্রাণ একত্রে কেড়ে নেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। আলহামদুলিল্লাহ সেই সময় এসব রোগ বিরাট অতঙ্কের কারণ হলেও এখন এগুলোকে মানুষ কোনো জটিল রোগ বলেই মনে করে না। ঐসকল রোগের তুলনায় করোনা অতি সাধারণ একটি ভাইরাস বলে মনে হয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার তুলনামূলক অতি সামান্য। এ যাবত যা রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে তাতে করোনায় মৃত্যুর অধিকাংশই অতিবৃদ্ধ, যাদের মৃত্যুর সময় স্বাভাবিক নিয়মেই চলে এসেছে। তাই করোনা দেখে আমাদের এতো আতঙ্কিত কিংবা ভয়ভীত হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করি না। এই রোগ দেখে হতাশা হওয়ারও কোনো কারণ নেই। আল্লাহ তা‘আলা যখন রোগটি প্রকাশ করেছেন নিশ্চয় তার ঔষধও পৃথিবীতে রেখেছেন। মানুষের চেষ্টা সাধনার সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যে এর নিরাময় অচিরেই বেরিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা একদিকে জানছি করোনার এখনো চিকিৎসা বের হয়নি। অপরদিকে দেখছি অতিবৃদ্ধ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত অধিকাংশ রোগিই সুস্থ হয়ে ফিরছেন। চিকিৎসা ছাড়া কেবল দুই তিন দিন পরিচর্যার মাধ্যমে যে রোগ থেকে নিরাময় পাওয়া যাচ্ছে তাকে এতো কঠিনভাবে প্রকাশ ও ব্যাপকভাবে প্রচার প্রসার চালিয়ে জনমনে এক বিরাট আতঙ্ক সৃষ্টি করার কী অর্থ জানি না।
এখন আমাদের করণীয়:
করোনার ভয়াবহতা আমাদের অস্থিরতা ও গুজবের তুলনায় অনেক কম হলেও তারপরও এটি একটি সংক্রামক ব্যধি; তাই এ ব্যাপারে নিশ্চয় আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে-
* সর্বপ্রথম আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তাওবাহ, ইসতিগফার, সালাত ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কাছে এসব বিপদ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করতে হবে। বিশেষ করে আমরা এই দুআটি পড়তে পারি-
« اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ ».
“হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় চাই শ্বেত, উম্মাদনা, কুষ্ট এবং সমস্ত দুরারোগ্য ব্যধি থেকে।” (সুনানু আবী দাউদ, বিতর অধ্যায়, আশ্রয় কামনা অনুচ্ছেদ)
* আমাদেরকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কোনো রোগের নিজস্বে কোনো ক্ষমতা নেই। কোনো রোগ আপন ক্ষমতায় সংক্রমণ করে না।
* অন্যান্য রোগের মতো করোনা একটি ভাইরাস জাতিয় রোগ। এই রোগ অনেক রোগের তুলনায় তুচ্ছ। তাই এতে বিচলিত বা অস্থির হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
* রোগ থেকে নিরাময় লাভের জন্য আমাদেরকে ডাক্তারী পরামর্শ মোতাবিক চলতে হবে এবং স্বাভাবিক থাকতে হবে।
* করোনা থেকে নিরাময়ের উপকরণ বের করার জন্য গবেষণা করতে হবে বা গবেষণাকারীদের সকল ধরণের সহযোগিতা করতে হবে।
* আল্লাহ তা‘আলা যেন এই রোগ থেকে নিরাময়ের উপকরণটি সহজে বের করার তাওফীক দান করেন সেই প্রার্থনা করতে হবে।
* মৃত্যুর ভয়ে অস্থির না হয়ে জীবনকে স্বাভাবিক রেখে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মুমিনরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। বরং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেয়।
উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত করোনার যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ চিহ্নিত করা হয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে এগুলো কেবল করোনায় হয় এমন নয়। যেমন হাঁচি, কাশি, জ্বর, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই করোনার প্রধানতম লক্ষণ। করোনা ছাড়া এগুলো আমাদের কাছে অতি স্বাভাবিক। তাই কারো এসব উপসর্গ দেখলেই আমরা করোনা বলে ধরে নেওয়া এবং তাকে বয়কট বা বর্জন করা খুবই অন্যায়। এতে আমরা রোগ ছাড়া ধারণা করে মানসিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে রোগী বানিয়ে দিবো। তবে এগুলো দীর্ঘ হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে করোনার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা অবশ্যই কাম্য।
আরো উল্লেখ্য যে, বিশ্বাসের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন কোনো বিষয়ে আমরা আমাদের জ্ঞানের বাহির থেকে কথা বলা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। কাকে, কোন দেশে, কী কারণে আল্লাহ তা‘আলা এই রোগ দিলেন? এর চুড়ান্ত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছেই রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানের অধিনস্থ বিষয়ে ধারণার বশে আমাদের কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। এতে অনেক সময় ধারণার বিপরীত হয়ে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। অতএব ধারণার আলোকে অজানা কথা বলা খুবই স্পর্ষকাতর।

আরও পড়ুন:  রোজার ঘাটতি পূরণে ফিতরা

লেখক: পরিচালক ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) ফতোয়া ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০