পিয়াইন-ধলাই-সারি নদী, প্রাকৃতিক নিসর্গ সৌন্দর্য আর সম্পদে ভরপুর জনপদ গোয়াইনঘাট-জৈন্তাপুর-কোম্পানীগঞ্জ (সিলেট-৪) আসন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ছিলেন ইমরান আহমেদ। ওই আসনে তিনি ৭ বার এমপি নির্বাচিত হন। এছাড়া টানা গত ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি এ আসনটি। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ আসনে চোখ বিএনপি ও জামায়াতের। তবে যে হারে গত কয়েকদিন ধরে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তালগোল পাকিয়েছেন তাতে এই আসনটি হাতছাড়া হতে পারে এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা।
স্থানীয় লোকজনের দাবি, এই আসনটিতে বিএনপি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কোন প্রার্থী দেয়নি। তবে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সিসিকের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। অন্যদিকে মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যরা বলছেন, এখনো কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। দলীয় সিদ্ধান্তের চিঠি এখনো পাননি কেউই।
এ অবস্থায় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একদিকে প্রচার চালাচ্ছেনÑ প্রকাশ্যে চলছে পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য। ফলে যেকোন সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না এলাকার লোকজন।
এদিকে বহিরাগত আর স্থানীয় প্রার্থীর দাবিতে উত্তপ্ত পুরো নির্বাচনী আসন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি। গোয়াইনঘাটের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরীর পক্ষে মশাল মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠেছে সীমান্ত জনপদের নির্বাচনী এলাকাটি। অপরদিকে মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির অন্য নেতারাও চালাচ্ছেন তাদের প্রচারণা। এ অবস্থায় কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক মনোনয়নের চিঠি না পাওয়ায় আরিফুল হক চৌধুরীর মনোনয়ন নিয়ে সীমান্তের এই জনপদে এখন ‘নির্বাচনী আগুন’ জ¦লছে।
বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সিলেট-১ আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। এ অবস্থায় মনোনয়ন বঞ্চিত আরিফুল হক চৌধুরী জরুরী তলবে ছুটে যান ঢাকায়। সেখানে হাইকমান্ডের কাছে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি।
কয়েক দফা বৈঠকের পর সিলেট-৪ আসনে নির্বাচন করার জন্য বলা হয় বলে তিনি জানান। এ সময় তিনি জানান, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে ওই আসনে নির্বাচন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। চেয়ারপারসনের নির্দেশে তিনি ওই আসনে প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানান।
পরদিন আরিফুল হক ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা নিয়ে গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির বিষয়টি জানান। এরপর থেকেই ক্ষোভের আগুনে পুড়তে থাকে সীমান্ত এলাকার জনপদের তিন উপজেলা Ñ জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ।
আসনটিতে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা আরিফুল হকের মনোনয়ন স্বঘোষিত দাবি করে নির্বাচনী এলাকায় বিক্ষোভ করছেন। তারা কোনোভাবেই আরিফের মনোনয়ন মেনে নিতে পারছেন না। এখনো মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।
জেলা বিএনপির উপদেষ্টা এবং দু’বারের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরীর অনুসারীরা আরিফুল হককে ‘বহিরাগত প্রার্থী’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করছেন। তাদের দাবি – ‘স্থানীয় প্রার্থী দিতে হবে, বহিরাগতদের স্থান নাই’। গত ৭ নভেম্বর রাত থেকে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল হচ্ছে। সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়কের একাধিক স্থানে মিছিলে সাবেক মেয়র আরিফকে সিলেট-৪ আসনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন আব্দুল হাকিম সমর্থকরা।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, সাবেক মেয়র আরিফুল হকের প্রার্থীতা ঘোষণার পর থেকে সিলেট-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সমর্থকরা নেট দুনিয়ায় ক্ষোভ ঝারেন। এমনকি আরিফকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ট্রল হয়। এছাড়াও সিলেটে বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি দিবসে দলীয় অনুষ্ঠানে সিলেট-১ আসনের মনোনীত প্রার্থী খন্দকার আবদুল মুক্তাদির আরিফুল হকের পরিচয় দিতে গিয়ে সম্ভাব্য সিলেট-৪ আসনের প্রার্থী বলে থেমে যান।
তারপর আরিফকে তখন মুক্তাদির বলেছিলেন, ‘আরিফ ভাই, আপনাকে সম্ভাব্য বলবো নাকি মনোনীত বলবো? আরিফ জবাবে বলেছিলেন, আমি পাইছি। এই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ট্রলের সৃষ্টি করে।
সিলেট-৪ আসনে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান, প্রয়াত দিলদার হোসেন সেলিম এমপির স্ত্রী অ্যাডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিম, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ও সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দিন আহমদ।
এ অবস্থায় আরিফের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রাপ্তির খবর অন্যরা এখনও মেনে নিতে নারাজ। তারা সকলেই নিজেদের প্রচারণা প্রতিদিন চলমান রেখেছেন। এমনকি বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় গিয়ে তারা আরিফ সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
সিলেট-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ও সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম বলেন,‘আমি এখনও মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি (আরিফ) নিজে নিজেকে ঘোষণা করেছেন। দল থেকে আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি। আমি মনে করি, এটা তিনি ( আরিফ) দলের সাংগঠনিক নিয়ম মেনে করেননি।’
সিলেট-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী বলেন, ‘তানরে (আরিফ) কে দিল ? দল থেকে তো কোনো ঘোষণা আমরা পেলাম না। তাইন (আরিফ) নিজে কইলে অইবো নি। আমি আমার নির্বাচনী শোডাইন ডেইলি দিরাম।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘মশাল মিছিল আমার হুকুমে হয়নি, আমার কর্মীরা দিছে। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তা মেনে নেওয়া হবে। তবে বাইরে থেকে কাউকে এনে দিলে কর্মীদের মধ্যে ভাঙন তৈরি হতে পারে। ভোটাররা চায় এলাকার পরিচিত মুখ।
সিলেট-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান বলেন, ‘দল থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই তিনি (আরিফ) মনোনীত হয়েছেন বলে দাবি করছেন। এটা উনার (আরিফ) মুখের কথা। যা সাংগঠনিক নিয়মের মধ্যে পড়ে না। তিনি মনোনয়ন পেলে দল থেকে আমরা সকলে নির্দেশনা পাবো।
এক প্রশ্নের জবাবে জামান আরও বলেন, ‘আমি তো পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলাম, দল আমার পদত্যাগ গ্রহণ করেনি। আবার আমাকেতো বহিষ্কারও করেনি। আমি এখনও বিএনপিতে আছি।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময় দল থেকে সিলেট-৪ ও সিলেট-৫ আসন স্থগিত করে রাখা হয়েছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত দল থেকে পরবর্তী ঘোষণা না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আসনটিতে আমরা সকলেই মনোনয়ন প্রত্যাশী। আর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের সবাইকে ওই আসনে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, আমি স্থানীয় প্রার্থী, জনগণের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমরা প্রচার চালাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে দলের চেয়ারপারসন সিলেট-৪ আসনে নির্বাচন করতে বলেছেন। তাই আমি প্রচারণায় নেমেছি।
এই নির্দেশনা মৌখিক নাকি লিখিত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলতে চাচ্ছি না। দলের হাইকমান্ড থেকে আমাকে বলা হয়েছে, তাই আমি নির্বাচনী প্রচারণায় এখানকার আলেম-উলামাসহ সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে কাজ করছি।’
স্থানীয়রা জানান, প্রার্থী নির্বাচনে ভূল সিদ্ধান্ত হলে সিলেট-৪ আসন হারাতে পারে বিএনপি।
মূল রিপোর্ট: সিলেটের মানচিত্র